১৪ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৬

নিজ সেবা নয় জনসেবায় নজর দিন

সুশাসন

ইকতেদার আহমেদ

সরকারি কর্মচারীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি। তাদের বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছেÑ ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে মন্ত্রণালয় সংশ্লেষে শীর্ষ পদ হলো সচিবের পদ। বর্তমানে কয়েকজন সচিবের পদকে সিনিয়র সচিবের পদে উন্নীত করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের অবস্থান সিনিয়র সচিবের ওপরে। বর্তমান অষ্টম বেতনস্কেলে সচিবরা ২০টি গ্রেডের ১ নম্বর গ্রেডে সর্বোচ্চ বেতনপ্রাপ্ত হন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব ও সিনিয়র সচিবদের স্কেলের গ্রেডবহির্ভূত রেখে ১ নম্বর গ্রেডের ওপরে বেতন দেয়া হচ্ছে। সচিব ও সিনিয়র সচিবরা একই ধরনের কর্ম সম্পাদন করে থাকলেও কোন্ নীতিমালা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে একই পদের বিভাজনÑ এ বিষয়ে দেশবাসীর কাছে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। পৃথিবীর কোথাও একই পদের এ ধরনের বিভাজন নেই।

সরকার কর্তৃক সর্বশেষ যে বেতন স্কেল ঘোষিত হয়েছে, তাতে সরকারের সর্বোচ্চ পদে নিয়োজিত সচিবদের জন্য যে বেতন, ভাতা ও সুবিধাদির বিধান করা হয়েছে, তা সরকারের আর্থিক সামর্থ্য এবং দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় অপর্যাপ্ত এমনটি দাবি করার কোনো অবকাশ নেই। সচিবেরা চালকসমেত গাড়ি ব্যবহারের জন্য সরকার কর্তৃক প্রাধিকারপ্রাপ্ত। সম্প্রতি সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন যেসব কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক চালকসমেত সরকারি গাড়ি ব্যবহারের জন্য প্রাধিকারপ্রাপ্ত, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সরকার দেয় গাড়ি ও চালকের পরিবর্তে বিনা সুদে গাড়ি ক্রয়ের জন্য ৪৫ লাখ টাকা ঋণ এবং গাড়িচালকের বেতন ও গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসিক ৪৫ হাজার টাকা ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা এ সুবিধাটি গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তারা ঠিকই মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভাগ অথবা প্রকল্প থেকে একাধিক গাড়ি ব্যবহার করে চলেছেন। আর তাই যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে গাড়ি ক্রয়ের জন্য সুদবিহীন ঋণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা সার্বিক বিবেচনায় ব্যাহত হচ্ছে।
জনগণের দেয় কর থেকে সচিবসহ সরকারের সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বেতন, ভাতা ও সুযোগ সুবিধা সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাহ করা হয়। দেশের সাধারণ জনমানুষ সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সংশ্লেষ ছাড়া নিঃস্বার্থ সেবা ও নিরাপত্তাপ্রত্যাশী। কিন্তু বেশির ভাগ সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেখা গেছে জনগণের সেবা ও নিরাপত্তার চেয়ে নিজের সেবা ও নিরাপত্তার বিষয়ে অধিক নিমগ্ন।

অতীতে সচিবদের জন্য বাসগৃহে বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর ব্যবস্থা ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে শোনা যায় সরকার সচিবদের জন্য বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর পরিবর্তে উভয়ের জন্য ১৬ হাজার টাকা করে ৩২ হাজার টাকা ভাতার ব্যবস্থা করেছে। সচিবরা ইতঃপূর্বে তিন হাজার টাকা গৃহস্থালি বাবুর্চি ভাতা পেতেন। সচিবেরা যখন গাড়িতে চলাচল করেন, তখন তাদের সাথে সার্বক্ষণিকভাবে পুলিশ বিভাগের কনস্টেবল পদমর্যাদার একজন গানম্যান অবস্থান করেন। সচিবরা তার কার্যালয়ে অবস্থানকালেও গানম্যান তার ব্যক্তিগত সহকারীর কক্ষে অপেক্ষমাণ থাকেন।
বাংলাদেশে বেকার সমস্যা প্রকট। সচিবেরা তাদের গৃহের জন্য বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরী জনবলের প্রাধিকারপ্রাপ্ত হয়ে থাকলে তা অক্ষুণœ রাখলেই বেকার সমস্যা লাঘবের জন্য সহায়ক হবে। কিন্তু প্রাধিকারপ্রাপ্ত জনবলের পরিবর্তে উভয় জনবলের জন্য সচিবদের যদি ভাতা দেয়া হয়, সে ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সচিব জনবল ব্যবহার না করেই অথবা যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে নিজ উদ্যোগে ওই সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করবেন। আর তাতে বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর পরিবর্তে এ বাবদ সরকার দেয়া অর্থের পুরোটাই সচিবেরা প্রাপ্ত হবেন।

বর্তমানে ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট বাড়িতে যারা বসবাস করেন, ওই সব ফ্ল্যাট বাড়ির নিরাপত্তার বিষয়টি মালিক সমিতি কতর্ৃৃক নিয়োগপ্রাপ্ত নিরাপত্তা প্রহরীদের দিয়ে নির্বাহ করা হয়। এ ধরনের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য প্রতিটি ফ্ল্যাট মালিক বা ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াকে মাসিক ভিত্তিতে নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এ অর্থ দিয়ে নিরাপত্তার পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতা, নৈশকালীন বৈদ্যুতিক বাতির সুবিধা এবং ক্ষেত্র বিশেষে লিফটের রক্ষণাবেক্ষণ ও বিদ্যুৎ ব্যয় নির্বাহ করা হয়। একজন ফ্ল্যাট মালিক বা ভাড়াটিয়াকে এ বাবদ প্রতি মাসে যে অর্থ ব্যয় করতে হয়, তা এলাকা ও সেবার মানভেদে তিন থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্তমানে সচিবসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা সরকারি ফ্ল্যাট বাড়িতে বসবাস করেন। এ সব ফ্ল্যাট বাড়ির বাইরের বিদ্যুতের ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার কাজ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ ও পুলিশ বিভাগের জনবল দিয়ে নির্বাহ করা হয়। আর এ কারণে পৃথকভাবে সচিবদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিরাপত্তা প্রহরী বা নিরাপত্তা প্রহরী ভাতা এ দু’টির কোনোটির আবশ্যকতা আছে কি না তা বিবেচনার দাবি রাখে।

বর্তমানে সচিব পদে যে সংখ্যক কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন, একই ও উচ্চ পদমর্যাদায় এর চেয়ে অনেক অধিকসংখ্যক কর্মকর্তা সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও দফতরে কর্মরত। সচিবদের জন্য বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর পদ সৃষ্টি এবং নিয়োগ না দিয়ে এদের বিপরীতে নির্ধারিত অঙ্কের ভাতা গ্রহণের সুবিধার বিষয়টি সমমানের ও এর চেয়ে উচ্চ পদে কর্মরত কর্মকর্তাদের অনুরূপ বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ অথবা নিয়োগের বিপরীতে ভাতার সুবিধা লাভের অধিকারী করে তুলেছে। সচিবদের চেয়ে সরকারের জ্যেষ্ঠতার মানক্রম তালিকার ঊর্ধ্বে অবস্থান করছেনÑ এমন অনেক পদধারী বাসগৃহে বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর সুবিধাপ্রাপ্ত হন না। যেমনÑ উচ্চ আদালতের বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনাররা, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনার, সংসদ সদস্য, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রমুখ। বর্তমানে জেলা জজেরাও সচিবের সমমর্যাদাসম্পন্ন ও একই স্কেলের অন্তর্ভুক্ত। সচিবদের জন্য কোনো বিশেষ সুযোগ-সুবিধা এবং সেই সুযোগ-সুবিধার পরিবর্তে ভাতার ব্যবস্থা করা হলে সমপদে ও ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত অন্য সবাই অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা ও ভাতার দাবিদার। সচিবদের এরূপ ভাতা দিয়ে অন্যদের বঞ্চিত করা হলে তা দেশের সর্বোচ্চ আইন, সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, তথা সুযোগের সমতার পরিপন্থী।

বর্তমানে ঢাকা শহরে উল্টো পথে গাড়ি চালানো উপদ্রব হিসেবে দেখা দিয়েছে। সচিব পদধারীরা গানম্যানের সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়ায় চলাচলের সময় তাদের গাড়ির সামনের অংশে চালকের বাম পাশের আসনে গানম্যান অবস্থান করেন। কিছু কিছু সচিবের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, তারা গানম্যানের সুবিধার বদৌলতে উল্টো পথে গাড়ি চালাতে কখনো দ্বিধান্বিত হন না। আবার গানম্যানের সুবিধাপ্রাপ্ত অনেক সচিবের স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদেরও দেখা গেছে গানম্যানসমেত স্কুল, কলেজ ও বাজারে উপস্থিত হয়ে নিজেদের অবস্থানের বিষয়ে জানান দেয়ার প্রয়াস পাচ্ছেন। সরকার ও সরকারের পদধারী হিসেবে সচিবদের দায়িত্ব হলো, জনগণের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার জন্য কাজ করা। জনগণের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞাপূর্বক নিজেদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে দেশ আগানোর পরিবর্তে পিছিয়ে যেতে থাকবে।

অতীতে সচিব পদে পদায়নের ক্ষেত্রে দেখা যেত, জ্যেষ্ঠতার মানক্রম তালিকার ঊর্ধ্বে অবস্থানকারী মেধাবীরাই এ পদে নিয়োগ লাভ করতেন। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে সচিব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে নজিরবিহীনভাবে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন ছাড়াও মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সততা প্রভৃতির পরিবর্তে দলীয় আনুগত্য অধিক গুরুত্ব পেয়ে আসছে। এর ফলে সচিব পদে যাদের নিয়োগ ঘটছে এদের বেশির ভাগই তুলনামূলক মান বিচারে আমাদের সার্কভুক্ত রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান প্রভৃতি দেশে কর্মরত সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাদের চেয়ে অনেক নি¤েœর। আর এ কারণে যেকোনো ধরনের দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের বেশির ভাগ সচিব পদমর্যাদাধারী কর্মকর্তা রাষ্ট্রের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
সম্প্রতি ঘোষিত সর্বশেষ বেতন স্কেলে সচিবদের জন্য যে বেতন, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে, তাতে কোনো সচিবের কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সঙ্গত কারণ নেই। কিন্তু রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রীর বক্তব্যে যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে, তা হলো সচিবরা দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত না হলে মন্ত্রণালয়ের ও অধীনস্থ কেউ দুর্নীতি করতে সাহস করবে না।

বিশেষত সচিবদের সাথে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির মাত্রা কমানোর ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। রাষ্ট্রের শীর্ষ পদধারীদের দুর্নীতি বিষয়ে এ ধরনের বক্তব্য থেকে দেশের সামগ্রিক দুর্নীতির চিত্র যে হতাশাব্যঞ্জক ও উদ্বেগজনক, সে সত্যটির প্রকাশ ঘটেছে। এ দেশের জনমানুষ অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছিল যে, সর্বশেষ বেতন স্কেল ঘোষণার পর যে হারে বেতন, ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে তাতে দুর্নীতি নির্মূল না হলেও এর মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশে দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি হ্রাসের বিষয়ে বেশির ভাগ সচিবের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের কার্যকর উদ্যোগ নেই।

পৃথিবীর কোনো দেশে সচিব বা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরকারের কাছ থেকে বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর সুবিধা বা ভাতা পান না। এ ধরনের সুবিধা রাজতান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচায়ক। গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার সাথে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা কখনো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সেবার মানসিকতা। আর তা নিশ্চিত করতে গেলে অবশ্যই নিজের সেবার পরিবর্তে জনসেবাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান,
রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/268136