১৩ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:২১

সিএমপির থানায় থানায় ওয়ারেন্ট বাণিজ্য

সিএমপির বিভিন্ন থানা পুলিশ বেপরোয়া ওয়ারেন্ট বাণিজ্যে লিপ্ত। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি থেকে শুরু করে গুরুতর অপরাধের মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে থানা ও আদালত থেকে ওয়ারেন্ট বা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও পুলিশ তা তামিল করছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওয়ারেন্ট গায়েব করে ফেলা হচ্ছে। আসামিদের কাছ থেকে অবৈধ ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থানা পুলিশ এটি করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালত থেকে জারি হওয়া ওয়ারেন্ট ২০ মাস পর রিসিভ করার নজিরও আছে। আর এতে করে মামলার বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ ন্যায়বিচার থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো আসামিদের হুমকি-ধমকিতে তটস্থ থাকছেন বিচারপ্রার্থীরা।
অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে বিভিন্ন থানায় পোস্টিং নেয়া ওসিরা বেপরোয়া ওয়ারেন্ট বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন। রহস্যজনক কারণে নীরব সিএমপির শীর্ষ কর্তারাও। সিএমপির ১৬ থানায় বর্তমানে ১৪ হাজারেরও বেশি ওয়ারেন্ট ঝুলে আছে।

সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সালেহ মোহাম্মদ তানভীর ১৬ থানায় বিপুলসংখ্যক ওয়ারেন্ট পেন্ডিং থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আদালত থেকে পাঠানো অনেক ওয়ারেন্ট মিসিং হচ্ছে। কেন মিসিং হচ্ছে বা ওয়ারেন্ট কেন তামিল হচ্ছে না, ওসিদের কাছে আমরা এর ব্যাখ্যা চাই।’ আসামিদের কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নেয়ায় ওয়ারেন্ট তামিল করা হছে না- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’ এর দায় কি শীর্ষ কর্মকর্তারা এড়াতে পারেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওয়ারেন্ট তামিলের দায়িত্ব থানা পুলিশের।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) খাতায় ১৪ হাজারেরও বেশি ওয়ারেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে সিআর মামলার ওয়ারেন্ট ৫ হাজার ২৮৯টি, জিআর মামলার ওয়ারেন্ট ৭ হাজার ৫৯টি ও সাজাপ্রাপ্ত আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ২ হাজার ২৬৭টি। বেশিরভাগ সময় দেখা যাচ্ছে কোর্ট থেকে পাঠানো ওয়ারেন্টের সঙ্গে থানা পুলিশের ওয়ারেন্টের সংখ্যার গরমিল রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম আদালতের প্রসিকিউশন শাখা থেকে আসামিদের ওয়ারেন্ট পাঠানো হলেও থানা পুলিশের কাছে যাওয়ার পরও তা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।

১৬ অক্টোবর প্রস্তুত করা এক হিসাবে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে জিআর মামলার ওয়ারেন্ট কোতোয়ালি থানায় পাঠানো হয়েছে ১ হাজার ৩৮টি। কিন্তু কোতোয়ালি থানা পুলিশ ওয়ারেন্ট গ্রহণ করেছে ৯৮২টি। দেখা যাচ্ছে, আদালত থেকে পাঠানো ওয়ারেন্টের সংখ্যার চেয়ে থানা পুলিশের কাছে থাকা ওয়ারেন্টের সংখ্যা কম। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে কোতোয়ালি থানায় যে সংখ্যক ওয়ারেন্ট আদালত থেকে পাঠানো হয়েছে সব থানার সংশ্লিষ্ট রেজিস্টারে নিবন্ধন করা হয়নি। ফলে এসব ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে গ্রেফতারেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না।

সেপ্টেম্বরে আদালত থেকে চকবাজার থানায় জিআর মামলার ওয়ারেন্ট পাঠানো হয় ১১১টি। থানা গ্রহণ করেছে ১১০টি। একটি ওয়ারেন্ট থানা পুলিশের রেজিস্টারে নিবন্ধন করা হয়নি। একই মাসে বাকলিয়া থানায় জিআর ওয়ারেন্ট পাঠানো হয় ৬৩২টি। থানা পুলিশ রিসিভ করে ৬২৯টি। ওই মাসে ৩টি ওয়ারেন্ট পুলিশে খাতায় নিবন্ধন করা হয়নি। একই অবস্থা সিআর মামলার ওয়ারেন্টের ক্ষেত্রেও। সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম আদালত থেকে কোতোয়ালি থানায় সিআর মামলার ওয়ারেন্ট পাঠানো হয়েছে ১ হাজার ৯৫৪টি। কিন্তু কোতোয়ালি থানা পুলিশ ওয়ারেন্ট রিসিভ করেছে ১ হাজার ৭৪৯টি। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আরও ২০৫টি ওয়ারেন্ট হাওয়া হয়ে গেছে। একইভাবে সেপ্টেম্বরে চকবাজার থানায় সিআর ওয়ারেন্ট পাঠানো হয় ২৮২টি। চকবাজার থানা পুলিশ গ্রহণ করে ২৫০টি। একইভাবে আদালতের প্রসিকিউশন শাখা থেকে বাকলিয়া থানায় ওয়ারেন্ট পাঠানো হয় ৯২৩টি। বাকলিয়া থানা পুলিশ রিসিভ করে ৮৬৪টি। বাকলিয়া থানা পুলিশের কাছে আরও ৫৯টি পৌঁছায়নি বা বাকলিয়া থানা পুলিশ গ্রহণ করেনি।
সাজাপ্রাপ্ত আসামির ওয়ারেন্টের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম আদালতের প্রসিকিউশন শাখা থেকে কোতোয়ালি থানায় সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট পাঠানো হয় ৭৬৩টি। থানা পুলিশ গ্রহণ করে মাত্র ৪৫২টি ওয়ারেন্ট। এ মাসে হালিশহর থানায় সাজাপ্রাপ্ত ওয়ারেন্ট পাঠানো হয় ৫৯টি। কিন্তু থানা পুলিশ রিসিভ করেছে ৫০টি। নয়টি ওয়ারেন্ট প্রসিকিউশন থেকে পাঠানো হলেও হালিশহর থানায় পৌঁছেনি বা গ্রহণ করেনি। অবশ্য আদালতের নিন্মস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করেও অনেক ওয়ারেন্ট থানা পুলিশের কাছে পাঠানো হয় না বলে অভিযোগ আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সাম্প্রতিক বছরে শীর্ষ কর্তাদের ম্যানেজ করে ও মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন থানায় পোস্টিং বাগিয়ে নিয়েছেন অনেক ওসি। যারা পোস্টিং নিয়েছেন তারা কতদিন একটি থানায় টিকতে পারবেন তার কোনো ঠিক নেই। এ কারণে তারা পদপ্রাপ্তির জন্য ‘বিনিয়োগ’ করা টাকা স্বল্প সময়ের মধ্যে তুলতে ওয়ারেন্ট বাণিজ্যে নেমেছেন। আসামি যত বড়ই হোক, অপরাধ যত বড়ই হোক টাকা নিয়ে তাদের অবাধে ঘোরাফেরা করার সুযোগ করে দিচ্ছে পুলিশ।

জারি হওয়ার ২০ মাস পর রিসিভ হল ওয়ারেন্ট : চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-৩-এ ২০১৬ সালের ১ মার্চ একটি মামলা (১৪১/১৬) দায়ের করেন এসএসসি পরীক্ষার্থী এক শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষার্থীকে শেষ পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়া হয়নি। নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার এক আসামির নাম মানিক। তার বাবার নাম জিয়াবুল হোসেন ওরফে জেবল হোসেন। বাকলিয়া থানাধীন কালামিয়া বাজার এলাকার কচুখাইয়াগো বাড়ির বাসিন্দা তিনি। একই বছরের ২৯ মার্চ এ মামলায় মানিকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। কিন্তু ২০ মাস ধরে সেই ওয়ারেন্ট পড়েছিল থানায়। রিসিভ হয়নি। সর্বশেষ এক সপ্তাহ আগে নজরে আসার পর বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরী সেই ওয়ারেন্ট এন্ট্রি করার নির্দেশ দেন।
চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এর বিশেষ পিপি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম সেন্টু এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, আদালত থেকে পাঠানো একটি ওয়ারেন্ট ২০ মাস পর রিসিভ হওয়ার বিষয়টি বিস্ময়ের। থানার ওসি কিংবা পুলিশ কমিশনার এর দায় এড়াতে পারেন না। অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা আসামিদের কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়েই ওয়ারেন্ট ধামাচাপা দিয়ে রাখছেন। এতে করে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

 

https://www.jugantor.com/last-page/2017/11/13/171256