১৩ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:২০

পাইপলাইন সম্প্রসারণে গড়িমসি পেট্রোবাংলার

নানা টালবাহানা আর আর খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ এবং পাইপলাইন সম্প্রসারণে গড়িমসি করছে পেট্রোবাংলা। এসব ক্ষেত্রে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার নাম ভাঙিয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে পেট্রোবাংলাকেন্দ্রিক একটি চক্র। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যাতে সহজে গ্যাস সংযোগ দেয়া না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট গ্যাস বিতরণ কোম্পানির রিপোর্টও আমলে নিচ্ছে না তারা। আবাসিক খাতের আইন দেখিয়ে অযৌক্তিকভাবে বাণিজ্যিক সংযোগ ও পাইপলাইন সম্প্রসারণ করতে দেয়া হচ্ছে না। শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের অভিযোগ, দেশে পর্যাপ্ত গ্যাস আছে। মাটির নিচেও রয়েছে গ্যাসের বিশাল ভাণ্ডার। গ্যাস উত্তোলন নিয়েও আছে নানা ষড়যন্ত্র। সরকার এরই মধ্যে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেট্রোবাংলাকেন্দ্রিক এ চক্রটি গ্যাস উৎপাদন কম দেখিয়ে ৫-৬ বছর ধরে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগের গতি শ্লথ করে রেখেছে। পাইপলাইন নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নেও নানা বাধা তৈরি করে রেখেছে। অভিযোগ রয়েছে, এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের সঙ্গে বিদেশি একটি মহলের যোগসাজশ রয়েছে।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশেষ কমিটি যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগের অনুমোদন দিয়েছে সেসব শিল্পকারখানায়ও নানা অজুহাতে সংযোগ দিচ্ছে না চক্রটি। মাসের পর মাস সংযোগ সংক্রান্ত ফাইল আটকে রাখছে। নানা কালাকানুন দেখিয়ে সরকারি বিতরণ কোম্পানিগুলোকে গ্রাহক আঙিনা পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। চক্রটি আবার শিল্প গ্রাহকরা নিজ খরচে পাইপলাইন নির্মাণ করে অনুমোদিত কারখানায় সংযোগ নিতে চাইলেও বাধা দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞার কথা বলে গ্রাহকদের মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেয়া, পাইপলাইন নির্মাণে পেট্রোবাংলা অহেতুক ও অযৌক্তিক আইনকানুন তৈরি করে রেখেছে। তিনি আরও বলেন, সব দেখে মনে হচ্ছে, এ সরকারের জ্বালানি খাতে যারা আছেন তারা কোনো যুক্তিতর্কের ধারধারেন না, যা ইচ্ছা তা-ই করেন।

তেল গ্যাস খনিজসম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, শিল্প-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও
কারখানায় গ্যাস সংযোগ উন্মুক্ত করা দরকার। সরকার না পারলে বেসরকারি উদ্যোক্তরা যদি অবকাঠামো তৈরিতে সহযোগিতা করতে চায়, সে উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হবে। অন্যথা দেশের শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকরা মনে করেন, এভাবে শিল্পবিরোধী আইন বা নীতি দিয়ে একটি দেশ কোনো দিন সামনে এগোতে পারবে না। শুধু গুটিকয়েক লোকের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে নিজেরা ভালো থাকতে পারবেন। কিন্তু দেশ ডুববে অন্ধকারে। দেশের চালিকাশক্তির অন্যতম উপাদান গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে দেশি-বিদেশি চক্রের হাতে। ফলে তারা চাইলে যখন-তখন দেশকে অন্ধকারে রাখতে পারবে। তাদের মতে, গভীর এ ষড়যন্ত্র ও সংকট থেকে মুক্তি পেতে জাতীয়ভাবে শিল্পবান্ধব আইন করতে হবে। এরপর গ্যাস সংযোগ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। দ্রুত উন্নত ও শক্তিশালী অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে হবে।

ব্যবসায়ীদের মতে, দেশীয় শিল্পকারখানা ধ্বংস করে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধের মাধ্যমে দেশকে বড় ধরনের বিপদের দিকে ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত চলছে। তাদের মতে, সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা একটি চক্র শেষ মুহূর্তে সরকারকে বিপাকে ফেলার জন্য এ ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এরা দেশের শত্রু, সরকারের শত্রু আর শিল্পের শত্রু। বিপুল অঙ্কের দুর্নীতি ও ঘুষ-বাণিজ্য করে পছন্দের কোম্পানিকে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগের অনুমতি দিচ্ছে। পাইপলাইন করে দিচ্ছে। অপরদিকে যারা নিজ খরচে পাইপলাইন নির্মাণ করে সরকারকে সহযোগিতা করতে চাচ্ছে, তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। খোদ পেট্রোবাংলার মধ্যেই ঘাপটি মেরে আছে সরকারবিরোধী এ চক্রটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে শিল্পকারখানা গড়ে উঠুক তা চক্রান্তকারীরা চায় না। তারা চায়, বাংলাদেশ যেন গ্যাস-বিদ্যুতে কোনো দিন স্বয়ংসম্পন্ন হতে না পারে। শিল্পে স্বয়ংসম্পন্ন হতে না পারে। এরা দেশকে পরনির্ভরশীল করে জিম্মি করে রাখতে চায়। আর এটা করে সরকারকে বিপাকে ফেলতে চায়।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ অবশ্য যুগান্তরকে বলেন, বিশেষ কমিটি যদি কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে গ্যাস সংযোগ দেয়ার অনুমোদন করে থাকে ওই প্রতিষ্ঠান অবশ্যই সংযোগ পাবে। কোনো গ্রাহক যদি নিজ খরচে পাইপলাইন নির্মাণ করতে চান তবে সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানির সুপারিশ আমলে নিয়ে আইনানুযায়ী পেট্রোবাংলা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। তিনি এক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান। তবে তিনি বলেন, বেসরকারি ইকোনমিক জোনগুলোতে সরকার গ্যাস সংযোগ ও পাইপলাইন নির্মাণে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। কোনো উদ্যোক্তা যদি বেসরকারি ইকোনমিক জোনের অনুমোদন পান এবং গ্যাস সংযোগসহ বিভিন্ন সহযোগিতা চায় পেট্রোবাংলা তা দ্রুত বাস্তবায়ন করবে। একই সঙ্গে আগামী ৩ মাসের মধ্যে গ্যাস সংকট আর থাকবে না বলেও জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) জামিল এ আলীমের স্পষ্ট জবাব, নতুন এলাকা বর্ধিত করে সরকার কোনো প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ দেবে না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা আছে বলেও তিনি জানান। বিশেষ কমিটি যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে গ্যাস সংযোগ প্রদানের অনুমতি দিয়েছে লাইন সম্প্রসারণজনিত সমস্যার কারণে সেগুলোর কি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে বিষয়ে বিশেষ কমিটিই সিদ্ধান্ত নেবে। পেট্রোবাংলার করার কিছু নেই। একাধিক কোম্পানি নিজ খরচে পাইপলাইন নির্মাণ করে গ্যাস সংযোগ নেয়ার আবেদন করেছে। এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের স্বপক্ষে মতামত দিলেও সিন্ডিকেট সেই ফাইল আটকে রাখছে বলে অভিযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে জামিল এ আলীমের (অপারেশন) কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লাইন সম্প্রসারণ করা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে। এ নিয়ে আইনও আছে। কিন্তু আইনের কোনো কপি দেখাতে পারেননি তিনি। এরপর তিনি পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক মার্কেটিং লুৎফুর রহমানকে টেলিফোন করে আইনের একটি কপি এ প্রতিবেদককে দিতে বলেন। অপরদিকে লুৎফুর রহমানের কাছে গেলে তিনিও শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য এ সংক্রান্ত কোনো আইন বা বিধিনিষেধের কপি দেখাতে পারেননি। ২০১৩ সালের ৮ মে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য তৈরি করা একটি আইনের কপি দেখিয়ে বলেন এটা সবার জন্য প্রযোজ্য। শিল্প ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য আলাদা কোনো আইন নেই বলে তিনি জানান। তবে বিশেষ কমিটির রিপোর্টগুলোতে এ বিষয়ে বলা আছে বলে জানান। এরপর তিনি টেলিফোনে পরিচালক অপারেশনের সঙ্গে আবার কথা বলেন। একপর্যায়ে এর বেশি কোনো তথ্য তার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় বলে জানান।

এর আগেও ২০১৫ সালে শিল্পে গ্যাস সংযোগ চালুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়ন না করে নানা ষড়যন্ত্র করেছিল পেট্রোবাংলা। ওই বছরের ৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় পরিদর্শন শেষে দ্রুত শিল্প ও বাণিজ্যিক কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় তিনি জ্বালানি বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে অসন্তোষও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু অভিযোগ আছে, এ সিন্ডিকেটটি তখনও পেট্রোবাংলায় থেকে নানাভাবে দেশীয় শিল্পের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। অভিযোগ আছে, এদের মধ্যে কেউ কেউ এতটাই প্রভাবশালী যারা চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বিদেশি সিন্ডিকেটের প্রভাব খাটিয়ে চুক্তি পর্যন্ত বাগিয়ে নিচ্ছেন।
অভিযোগ আছে, এ সিন্ডিকেট এখনও পেট্রোবাংলায় অবস্থান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন উন্নয়নমূলক নির্দেশনা যাতে বাস্তবায়ন না হয় সেজন্য মরিয়া হয়ে কাজ করছে। অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ সুবিধা নিয়ে বা এ সিন্ডিকেটের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে গ্যাস সংযোগ ও পাইপলাইন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের গুরুতর অনিয়মের ক্ষেত্রে বিশেষ কমিটির প্রধান জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীকেও অনেক সময় অন্ধকারে রেখে সিন্ডিকেট চক্র পর্দার আড়ালে রমরমা সংযোগ বাণিজ্য করছে। মূলত এ গোপন বাণিজ্য বহাল রাখতে মহল বিশেষ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পর্যন্ত আমলে নিচ্ছে না।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/13/171246