১৩ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:১৫

গুমের প্রতিবাদে রাজপথে বিশিষ্টজনেরা

অপরাজেয় বাংলায় মানববন্ধন ; সিজারকে খুঁজে দিতে আলটিমেটাম

নিখোঁজের ছয় দিন অতিবাহিত হলেও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বের হাসান সিজারের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি। সিজারকে উদ্ধারে যেকোনো ক্লু পাওয়ার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তবে সিজারের এভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না স্বজনরা। তাদের ধারণা, গবেষণা বা লেখালেখির কারণে সিজার কোনো একটি পক্ষের বিরাগভাজন হয়ে থাকতে পারেন।

এ দিকে শিক্ষক সিজারকে তিন দিনের মধ্যে উদ্ধার করতে পুলিশকে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে গতকাল অপরাজেয় বাংলায় অনুষ্ঠিত এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে। সিজারের সাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বিভাগের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী, স্বজন, বিশিষ্টজন ও শুভাকাক্সক্ষীরা মানববন্ধন করে এ দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি নিখোঁজ মোবাশ্বের হাসান সিজারকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তারা। তাদের দাবি, বেনামী সূত্রের বরাতে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার বন্ধ করতে হবে।
এ দিকে অপহৃতদের খুঁজে পেতে সময় চেয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গতকাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, যারা নিখোঁজ হয়েছেন তাদের খুঁজে বের করতে না পারাটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর ব্যর্থতা নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে, তাদের সময় দিতে হবে। সিজারের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার থেকে সিজার নিখোঁজ। সে দিন বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত সিজারের অবস্থান ছিল আগারগাঁও লায়ন্স ভবন, আইডিবি ভবনকেন্দ্রিক। সন্ধ্যা ৬টা ৪১ মিনিটে তার মোবাইলে সর্বশেষ ফোন এসেছিল, তখনো তিনি একই স্থানে ছিলেন। মোবাইল ট্রাকিংয়ে এ তথ্য জানা গেছে। তার পর থেকে সব নেটওয়ার্ক বন্ধ। নর্থ সাউথ শিক্ষক মোবাশ্বের হাসান সিজারকে খুঁজে পেতে অগ্রগতি কী জানতে র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, এখনো সিজারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে তার সন্ধান পেতে র্যাবের তৎপরতা অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, সিজারের পরিবারকেও বলা আছে যে, বাসায় এ বিষয়ে কোনো প্রকার কল বা সন্ধানের কোনো ক্লু পেলে র্যাবকে জানাতে।

এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব-৩ অধিনায়ক বলেন, সিজারের জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য এই মুহূর্তে আমাদের কাছে নেই। তবে যতটুক জানতে পেরেছি তিনি জঙ্গিদের নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক লেখালেখি করেছেন।
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজেয় বাংলার সামনে এক মানববন্ধনে গুম ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ছাত্র, শিক্ষকেরা। পাশাপাশি নিখোঁজ মোবাশ্বের হাসান সিজারকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তারা। এ সময় সিজারকে তিন দিনের মধ্যে উদ্ধার করতে পুলিশকে সময় বেঁধে দেয়া হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্রকে গুমের সংস্কৃতিকে লালন না করার আহ্বান জানিয়ে বক্তারা বলেন, যদি সে (সিজার) কোনো অন্যায় করে থাকে তাকে প্রকাশ্যে এনে বিচার করুন। যদি কেউ তাকে অপহরণ করে থাকে বা নিজে আত্মগোপন করে থাকে তাহলেও সন্ধান দেয়াটা সরকারের দায়িত্ব। সিজারের নিখোঁজ থাকার ঘটনায় অন্যরাও উদ্বেগের মধ্যে আছেন বলেও উল্লেখ করেন তারা। মানববন্ধনে সিজারের সহপাঠী, বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক, স্বজন, শুভানুধ্যায়ীসহ সমাজের বিশিষ্ট জনেরা অংশ নেন। বক্তব্য দেন সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান, শিক্ষক গীতি আরা নাসরিন, রোবায়েত ফেরদৌস, সিজারের ছোট বোন তামান্না প্রমুখ।

অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, গুম ভয়াবহ ব্যাপার। যে-ই গুম করুক না কেন, তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তিনি বলেন, রাষ্ট্র প্রয়োজনে যেকোনো নাগরিককে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে পারে। তবে সেটি নিয়ম অনুযায়ী হতে হবে। বিশ্বায়ন, ইসলাম, জঙ্গিবাদ নিয়ে নানা গবেষণা করছিলেন এ সিজার। তার এসব কাজের সাথে তার অন্তর্ধানের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার আছে। মানববন্ধনেও এ বিষয়টি উঠে আসে। রুবায়েত ফেরদৌস বলেন, রাষ্ট্র সৃষ্টির অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো নাগরিককে নিরাপত্তা প্রদান। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। জঙ্গিবাদ ও নিরাপত্তা নিয়ে সিজারের গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্র শিক্ষক ও গবেষকদের প্রতিপক্ষ হয়ে যাচ্ছে, যেটা নিতান্তই দুঃখজনক।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন বলেন, আমাদের দেশে প্রতি ১০০ ঘণ্টায় একজন করে গুম ও নিখোঁজ হচ্ছে। এটা দেশের জন্য খুবই হতাশাজনক। তিনি বলেন, গুমের ঘটনা দেশে এ প্রথম নয়। কিন্তু ক্ষমতাবান ব্যক্তি এ ঘটনাকে স্বাভাবিক হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাইছেন। যদিও এটি স্বাভাবিক ঘটনা নয়। সিজারের ছোট বোন তামান্না তার ভাইকে যেকোনো মূল্যে ফেরত চেয়ে জানিয়েছেন, তার ভাইকে উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। তামান্না বলেন, আমার ভাইয়ের নামে কেউ মিথ্যা তথ্য ছড়াবেন না। দরকার হলে আমাদের সাথে তার ব্যাপারে কথা বলুন। কোনো তথ্য লাগলে আমরা দেবো।

জানা গেছে, সিজার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। একসময় সাংবাদিকতাও করেছেন। পরে যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স ও অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করেন। মোবাশ্বের হাসান সর্বশেষ গবেষণা করছিলেন রিসলভ নেটওয়ার্কের একটি প্রকল্পের অধীনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিস এ নেটওয়ার্কের উদ্যোক্তা। রিসলভ বিশ্বের ১০টি দেশে গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করছে। গত বছর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে গবেষণার জন্য পছন্দ করে প্রতিষ্ঠানটি। ওই প্রকল্পে গণতন্ত্র, রাজনৈতিক সহিংসতা, মৌলবাদ, ধর্ম ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে গবেষকেরা কাজ করেন। এর মেয়াদ ছিল জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ওই প্রকল্পেরই একজন ফেলো ছিলেন মোবাশ্বের হাসান। তার প্রবন্ধের নাম ছিল ‘দ্য ল্যাংগুয়েজ অব ইয়থ পলিটিকস ইন বাংলাদেশ : বিয়ন্ড দ্য সেক্যুলার রেলিজিয়ন বাইনারি’। মোবাশ্বের ওই প্রবন্ধ ওয়াশিংটন ডিসিতে উপস্থাপনও করেন। তার প্রবন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কী বোঝেন, ধর্মচর্চা কিভাবে করছেন, বিবর্তনগুলো কোথায় হয়েছে, সে সম্পর্কে বলেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/267923