১৩ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:১৪

রাজধানী জুড়ে নতুন পুরনো লাইন একাকার

বছরের প্রায় সময়েই রাজধানীর মগবাজারস্থ মিরবাগ এবং মিরেরটেক এলাকায় পানির চরম সংকটের অভিযোগ আসে। এলাকাবাসী জানায়, বছরের প্রায় পুরো সময়েই এখানকার অধিবাসীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। একই অবস্থা রাজধানীর অনেক এলাকায়। অথচ ঢাকা ওয়াসা বলছে, তারা চাহিদার তুলনায় বেশী পানি সরবরাহ করছে। তাহলে প্রশ্ন উঠে, চাহিদার তুলনায় পানি সরবরাহ বেশী হলে নগরীতে পানি সংকট কেন?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় এখনো রয়ে গেছে ওয়াসার পুরনো পানির লাইন। নিয়ম অনুযায়ী নতুন লাইন বসানোর পর পুরনো পানির লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে উঠানোর কথা থাকলেও সেটি হয়নি। নতুর লাইনের পাশাপাশি পুরনো লাইনও রয়ে গেছে। ফলে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি নতুন এবং পুরাতন এই দুই লাইন দিয়েই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। এর ফলে একদিকে পানির যেমন অপচয় হচ্ছে তেমনি অনেক এলাকায় পানিও পাওয়া যায়না।
ওয়াসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন দাতা সংস্থার অনুদানেই ওয়াসার বেশীরভাগ উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে একটি কাজ একাধিক ঠিকাদারের হাত দিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। নতুন লাইন বসানোর ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটছেনা। মূল ঠিকাদার যখন সাব ঠিকাদারকে কাজ দেয় তখন তারা আর কাজটি নিয়ে বেশী তদারকি করেনা। ওয়াসা কর্তৃপক্ষও সেভাবে কাজের মনিটরিং করেনা। ফলে ঠিকাদারদের যেনতেন কাজের ফল ভোগ করতে হয় নগরবাসীকে।

সূত্র মতে, ঢাকা ওয়াসার ৫নং জোন মহাখালী, বনশ্রী, গুলশান, কাওরান বাজার এলাকায় নতুন লাইন বসানো হয়েছে। অথচ সেখানে থাকা আগের পুরাতন পানির লাইন উঠানো হয়নি। গত ছয় বছর ধরে পুরাতন লাইন উঠানো হচ্ছে। যখন কোনো এলাকাতে পানি সমস্যা দেখা দেয় তখন ওয়াসার হস্তক্ষেপে ঠিকাদার কিছু পুরনো লাইন তুলে নেয়। জানা গেছে, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলি, পুরান ঢাকা, মগবাজারসহ অনেক লাইন ডুয়েল (দুইটি) লাইন রয়েছে। এখন এই দুই লাইন দিয়েই পানি যাচ্ছে। এতে করে ওয়াসার একদিকে যেমন পানির অপচয় হচ্ছে তেমনী রাজস্বও হারাতে হচ্ছে।
ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা জানান, ডুয়েল লাইন থাকা এলাকাগুলোতে একদিকে যেমন সমস্যা হচ্ছে তেমনী কেউকেউ সুবিধাও ভোগ করছেন। অনেক হোল্ডিংয়ে (বাসা) নতুন এবং পুরাতন দুই লাইনেই পানি যাচ্ছে। অথচ এসব হোল্ডিংয়ের একটি লাইনের বিল জমা দিতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ওয়াসার রাজস্ব কর্মকর্তারা হোল্ডিংয়ের মালিকের সাথে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে ভুতড়ে বিল জমা দেন। বাসার মালিক অল্প টাকায় অতিরিক্ত পানি পেয়ে থাকেন। ভুতড়ে (গড়) বিলের মাধ্যমে অর্থ আদায় করে রাজস্ব কর্মকর্তারা। আবার অনেক বাসায় পানি প্রবাহ কম থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট অংকের একটি বিল জমা দিতে হচ্ছে।
সমস্যার কথা বলতে গিয়ে ওয়াসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডুয়েল লাইনের কারণে অনেক এলাকার বাসিন্দারা ঠিকমত পানি পায়না। কারণ হিসেবে তারা বলেন, পুুরাতন পানির লাইন না তুলে ঠিকাদাররা নতুন লাইন বসিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে তাদের পুরাতন লাইনের অনেক নীচেই নতুন পানির লাইনটি বসাতে হয়। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নীচে লাইন থাকায় পানি সরবরাহে বিঘœ ঘটে। জানা গেছে, নতুন পানির লাইন বসানো থেকে পুরনোটা উঠানো বেশী কষ্টের এবং অর্থ খরচও বেশী হয়। কারণ জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাইনগুলো উঠাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়। তাই ঠিকাদাররা নতুন লাইন বসানোর সময় অর্থ এবং সময় বাঁচাতে পুরনোটি উঠায় না।

সূত্র মতে, নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে ঢাকা ওয়াসা নতুন নতুন পরিকল্পনা করছে। এক্ষেত্রে সংস্থাটি বিশেষভাবে নজর দিয়েছে সিস্টেম লস কমানোর দিকে। কয়েক বছর আগেও সিসেস্টম লস ছিল ৪০ শতাংশ। তবে সেটি এখন ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদিত পানির কি পরিমাণ কোন লাইন দিয়ে যাচ্ছে সেটি বুঝা যাচ্ছেনা। ফলে পানির হিসেবেও রাখা যাচ্ছেনা। পুরাতন লাইন সম্পূর্ণভাবে উঠানো হলে সিস্টেম লস অনেক কমে যাবে।
সূত্র মতে, ১৯৬৩ সালে ঢাকা ওয়াসার যাত্রা শুরু হয়। পুরান ঢাকার কিছু এলাকাসহ সামাণ্য অংশে প্রথম দিকে পানি সরবরাহ শুরু হয়। দীর্ঘ ৫০ বছর পর প্রায় চার হাজার কিলোমিটার লাইন দিয়ে দেড়কোটি মানুষের ঢাকায় পানি সরবরাহ করছে ঢ্কাা ওয়াসা। যা ৬ বছর আগেও ছিল তিন হাজারের কাছাকাছি। প্রতিনিয়ত রাজধানীর আয়তন বৃদ্ধি পাওয়ায় পানির চাহিদাও বাড়ছে। নতুন নতুন পানির লাইনও বসাতে হচ্ছে। অন্যদিকে পুরনো পানির লাইন নষ্ট হওয়ায় সেগুলো পরিবর্তনও করা হচ্ছে। এদিকে পানির পাইপের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, পানির লাইনের জন্য চীন থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাইপ আমদানি করা হয়। এসব পাইপের ব্যাস ২১ মিলিমিটার হওয়ার কথা। যদিও আমদানি করা হয় ১৫ দশমিক ৫ মিলিমিটার ব্যাসের পাইপ। এ নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আপত্তি দেয়। অভিযোগ রয়েছে, পাইপের ব্যাস কমিয়ে কম দামে পাইপ এনে ওই অর্থ আত্মসাত করা হয়েছে।

জানা গেছে, সকল গ্রাহকের সংযোগ মিটার স্থাপন, পানির অপচয় কমানো, এবং জাতীয় পর্যায়ে পানি সাশ্রয়ের পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসার সাতটি জোনে পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ ও ৮২টি নতুন জেলা মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওয়াসা। এ লক্ষ্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে ২৭ দশমিক ৫ কোটি ডলারের (২৭৫ মিলিয়ন) ঋণচুক্তি হয়েছে। প্রতি ডলারে ৮০ টাকা ধরে বাংলাদেশী মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ইআরডির সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন এবং বাংলাদেশে নিয়োজিত এডিবি’র কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্যাজুহিকো হিগুচি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রকল্পের আওতায় এ ঋণ দেবে সংস্থাটি। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪০৮ মিলিয়ন ডলার। বাকি অর্থ সরকারি খাত থেকে মেটানো হবে। ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। ঢাকা মহানগরীতে ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে শহর অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ পানির সুবিধার আওতায় এনে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করাই এর প্রধান টার্গেট। আগে থেকেই ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই সেক্টর ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম ও ঢাকা এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্প চলমান আছে। এ দু’টি প্রকল্পের অধীনে ৪৭টি ও ১৫টি ডিস্ট্রিক্ট মিটারিং এরিয়া (ডিএমএ) প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রকল্প দু’টির কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই ও নির্ভরযোগ্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। এডিবির দেওয়া ঋণ ৫ বছরের রেয়াতি মেয়াদসহ ২০ বছরে পরিশোধযোগ্য। তবে ঋণে সুদের হার লন্ডন ইন্টার ব্যাংক অফার্ড রেটভিত্তিক। জানা গেছে, এভাবে প্রতিবছরই দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তায় বড়বড় প্রকল্প হাতে নেয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু কোনো প্রকল্পই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি। এছাড়া পানি সরবরাহ স্বাভাবিক করতে ওয়াসার মনিটরিংও ঠিক মত হচ্ছেনা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান এ সংগ্রামকে জানান, ওয়াসার যেকোন প্রকল্প বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেই প্রকল্পগুলোর সার্বিক চিত্র এক নয়। তিনি বলেন, রাজধানীর অধিকাংশ এলাকাতেই নতুন পানির লাইন বসানোর কাজ চলছে। ওয়াসা সেগুলো মনিটরিংও করছে। পুরনো পানির লাইন তুলে না আনার বিষয়টি তিনি অবহিত আছেন বলে জানান।

ওয়াসার হিসাব মতে, বর্তমানে প্রতিদিন চাহিদার ২৪০ কোটি লিটার পানির ৭৮ শতাংশ ভূগর্ভস্থ থেকে গভীর নলকূপের মাধ্যমে তোলা হয়। বাকি ২২ শতাংশ পানি ভূ-উপরিস্থ ক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়। ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সিস্টেম লস বাদ দিলে নগরবাসী পানি পায় মাত্র ১৭০ থেকে ১৭৫ কোটি লিটার পানি। যা চাহিদার ৭০ কোটি লিটার কম। ওয়াসার উদ্দেশ্য ছিল, ২০২১ সালের মধ্যে রাজধানী বাসীর পানির চাহিদা পূরণ করা। কিন্তু নতুন এবং পুরনো লাইনে যেভাবে পানি সরবরাহ হচ্ছে তাতে পানির অপচয় হচ্ছে আরও বেশী।

http://www.dailysangram.com/post/307444