১২ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৬:১৮

মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

# দেশীয় শিল্পখাতে বিনয়োগ কোথায়?
# আমদানি করা মূলধনী যন্ত্রপাতি যায় কোথায়?
এইচ এম আকতার : চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানির পরিমাণ বাড়লেও বিনিয়োগের খরা কাটছে না। বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি অনেক বেশি হারে বেড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে বিনিয়োগ না হলে আমদানি করা এসব মূলধনী যন্ত্রপাতি যায় কোথায়। আমদানি বৃদ্ধিতে দেশের বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত বহন করলেও কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ। যা বিনিয়োগ কমার ইঙ্গিত। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে অর্থ পাচারের আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের। এতে করে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, দুই দফা বন্যায় খাদ্য সঙ্কট এড়াতে সরকার শুল্ক কমিয়ে আনার পর সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়েই চাল আমদানি বাড়ছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথমার্ধে চাল আমদানির জন্য ৯৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এলসি (ঋণপত্র) খোলা হয়েছে। এই অংক গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে ৫৩১৬ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে চাল আমদানিতে ব্যাংকগুলোয় ৫৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পুরোটা সময় চাল আমদানিতে ২৭ কোটি ৪১ লাখ ডলার এলসি খোলা হয়। অর্থাৎ গত বছর ১২ মাসে চাল আমদানিতে যে ব্যয় হয়েছে, চলতি অর্থবছরের শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই তার দ্বিগুণ ব্যয় হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) চাল আমদানিতে ৯৩ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮৫ গুণ বেশি। গত অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে চাল আমদানিতে মাত্র ৫০ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়। আলোচ্য সময়ে চাল আমদানিতে খোলা ৩৩ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। গত বছরে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৩৫ লাখ ডলারের এলসি। নিষ্পত্তির হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৯১ গুণ।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে এলসি খোলায় ১ হাজার ৪৭০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময় এই ব্যয় ছিল ১ হাজার ৭৭ কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৩৬ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ১ হাজার ১৮২ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। গত অর্থবছরে নিষ্পত্তি হয় ১ হাজার ১৬১ কোটি ডলারের এলসি। আলোচ্য সময়ে শিল্পের মূলধন যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলার হার অনেক বেড়েছে। বিভিন্ন শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১৩২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে এলসি খোলায় ব্যয় হয় ১০৩ কোটি ডলার। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় ৩৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১১১ কোটি ডলার।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে সুতা (ইয়ার্ন) আমদানির এলসি বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। ওষুধের কাঁচামালে বেড়েছে ৫১ শতাংশ, মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) ৬৯ শতাংশ এবং জ্বালানি তেল আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৯ শতাংশ।
জুলাই মাসে ৪০৪ কোটি ৬০ লাখ ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা গত বছরের জুলাই মাসের চেয়ে ৪৪ শতাংশ বেশি। গত বছরের জুলাই মাসে ২৮০ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়।

মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি অনেক বেশি হারে বেড়েছে। যা দেশের বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু একই সময়ে কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ। যা বিনিয়োগ কমার ইঙ্গিত। আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করতে হচ্ছে সরকারকে। এর ফলে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে খাদ্য আমদানিও।
মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়লেও সে অনুপাতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি না বাড়ায় এর আড়ালে অর্থ পাচারের আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, আমদানি বাড়লেও এর বিপরীতে পণ্য আসছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। এক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানান তারা। ওভার ইনভয়েসিং হলো, কম দামের পণ্য বেশি দাম দেখিয়ে টাকা পাচার করা। যে পরিমাণ আমদানি হচ্ছে ওই পরিমাণ পণ্য দেশে আসছে কিনা এ নিয়েও সংশয় রয়েছে। ফলে প্রকৃত আমদানি বাড়ছে না বলেই তাদেরও ধারণা।

এদিকে, গত কয়েক বছর ধরেই বেসরকারি খাতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্যের পাশাপাশি বাড়ছে অলস অর্থের পরিমাণও এবং অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ব্যাংক ঋণের সুদহারও কমেছে। যা বর্তমানে একক অঙ্কে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগ বাড়ার কথা থাকলেও তা বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথমার্ধের (জুলাই-জুন) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বেশ কিছুটা কমিয়ে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছরের ১১ মাসে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে ১৬ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানি বাড়লে দেশের বিনিয়োগ বাড়ার কথা। যেহেতু কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ বাড়ছে না, তাই এলসির বিপরীতে পণ্য আসছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দেশের অর্থ পাচার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং কাস্টমস বিভাগকে নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন, ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে কখনোই ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়।
যদিও সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক গর্বনর ফজলে কবির চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বলেছেন, সরকার ঘোষিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের ধারা বজায় রাখতে কাজ করছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। সেজন্য বড় ঋণের পরিবর্তে ছোট ছোট খাতে বেশি ঋণ দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কোনো রকম অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় যাতে উন্নয়ন ব্যাহত না করে, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।
কর্পোরেট খেলাপির সংস্কৃতি যেন আর্থিক খাতকে গ্রাস করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ প্রবাহ কমিয়ে এনে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘সঙ্কোচনমূলক’ মুদ্রানীতি দিল কি না- এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে গর্বনর বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে নতুন মুদ্রানীতির মাধ্যমে সেটা সম্ভব। এটি স্থিতিশীলতা ও কর্মসংস্থান সহায়ক প্রবৃদ্ধিমুখী মুদ্রানীতি।
এদিকে, ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্প-কারখানা বসানোর পরও বিভিন্ন সমস্যার কারণে উৎপাদনে যেতে পারছেন না তারা। যে কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতির তুলনায় শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কম। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, অসংখ্য কারখানায় নতুন যন্ত্রপাতিসহ বিনিয়োগ হয়েছে, উৎপাদনের জন্য তারা প্রস্তুত, কিন্তু গ্যাস সংযোগের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক বছর ধরে দাবি করা হচ্ছে। উদ্বৃত্তের অজুহাতে চাল রফতানিও করা হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে খাদ্য মজুদ সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে। গত মাস পর্যন্ত সরকারি গুদামে চাল ছিল মাত্র ১ লাখ ৯১ হাজার টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬ লাখ ৯৬ হাজার টন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার মোট ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৮১২ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে এই ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৩৩৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এলসি খোলার ব্যয় বেড়েছে ১১ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় এই ব্যয় বাড়ে মাত্র দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া গত অর্থবছরে এলসি নিষ্পত্তির ব্যয় সাড়ে ১০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৪২৭ কোটি ডলার। আগের বছর এ ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৭ কোটি ডলার। এলসি নিষ্পত্তিতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় ব্যয় বাড়ে মাত্র ৪ দশমিক ২২ শতাংশ।
নামে বেনামে আমদানি করে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। এমন অভিযোগে শুল্ক গোয়েন্দা চট্টগ্রামে কন্টিনার আটক করলেও মূল হোতারা এখনও ধরা ছোয়ার বাহিরে রয়ে গেছে। নারায়নগঞ্জের এক রিক্সা চালকের নামে কোটি কোটি টাকার পণ্য আমদানি করলেও সে জানেনা কে বা কারা তার নামে পণ্য আমদানি করেছে বা কি পণ্য আমদানি করেছে।
তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড আর ঠিকানা ব্যবহার করে এসব পণ্যের নামে কোট কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। একই ভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি নামেও মোটা অংকের টাকা পাচার হচ্ছে। পাচারের তথ্য ফাস হলেও পাচারকারিরা থাকেন নিরাপদে। আর এসব কারনেই পাচার বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে। আর আমাদের অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমানও বেড়েছে। যা অর্থনীতিতে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে।

http://www.dailysangram.com/post/307280