১২ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৬:১৭

সিটি টোল’ চাঁদাবাজির নতুন কৌশল

ছাপানো রশিদে চাঁদা আদায় ; জানে না সিটি করপোরেশন; লিজ নিয়েছি : আদায়কারী

সিটি করপোরেশন কিছুই জানে না। তবুও রাজধানীতে প্রকাশ্যে তোলা হচ্ছে তথাকথিত ‘সিটি টোল’। শুধু আদায়ই করা হচ্ছে না, এ জন্য দেয়া হচ্ছে ছাপানো রশিদ। সিটি টোলের নামে রাজধানীজুড়ে শুরু হয়েছে অভিনব চাঁদাবাজির কৌশল। একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র রাজধানীর বিভিন্ন টার্মিনালে ঘুরে ঘুরে টোলের নামে এই চাঁদা আদায় করছে। সাধারণ পথচারী হাতের একটি পোঁটলা নিয়ে গাড়িতে উঠতে গেলেও চাঁদা দিতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিভিন্ন এলাকায় সরকারদলীয় স্থানীয় কতিপয় নেতা ও মাস্তানরা এই চাঁদা নিচ্ছে। চাঁদা না দিলে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে যাত্রী-পথচারীদের। সরেজমিন দেখা গেছে, সিটি করপোরেশনের নামেই প্রকাশ্যেই এই টোল আদায় হচ্ছে। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তাদের সিটি করপোরেশন প্রদত্ত লিজের কাগজও দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তাই এ বিষয়ে কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

রাজধানীর গুলিস্তান, মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, বাবুবাজার ব্রিজসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় বাস টার্মিনাল ও বাস স্টপেজগুলোতে সিটি টোল আদায় করা হচ্ছে। কোনো পথচারী হাতের ব্যাগ-পোঁটলাসহ গাড়িতে উঠতে গেলেই তাকে টোলের টোকেন ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা এই টোল নিচ্ছে তাদের বক্তব্য এটি বৈধ। একজন মানুষ কোনো মাল নিয়ে গাড়িতে উঠছে বলেই তাদের কাছ থেকে এই টোল আদায় করা হচ্ছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার বাসিন্দা মেহেদি হাসান জানান, গুলিস্তান থেকে কিছু মালামাল কিনে তিনি তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে গুলিস্তান বাস টার্মিনালে এক ব্যক্তি এসে তার কাছে টোল দাবি করেন। ওই যুবকের বক্তব্য হচ্ছেÑ এভাবে কোনো মাল কিনে গাড়িতে উঠতে গেলে টোল দিতে হবে। মেহেদী বলেন, কেউ গাড়িতে উঠবেন না হাতে মালামাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকেও টোল দিতে হচ্ছে। চাঁদাবাজেরা মানুষকে বাধ্য করছে টোল দিতে।

রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় গতকাল বিকেলে দেখা যায়, এভাবে বেশ কয়েকজন যুবক সাধারণ পথচারীদের কাছ থেকে টোল আদায় করছে। কাইউম নামে এক যুবক বলেন, তিনি তিনটি ফ্যান কিনে শনির আখড়া যাচ্ছিলেন। গাড়ির জন্য তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় এক যুবক এসে তাকে ২০ টাকার একটি স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে গেল। কাইউম বলেন, ‘এখন দেখছি রাস্তায় হাঁটতেও ট্যাক্স দেয়া লাগবে।’ সিরাজ নামে এক যুবক বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই চাঁদাবাজেরা সক্রিয়। গাড়ি যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ তাদের চাঁদাবাজিও চলবে। গতকাল বিকেলে দেখা যায়, তৈয়ব ও আওলাদের নামে গুলিস্তানে টোল আদায় চলছে। যারা টোল আদায় করছে তাদের একজন জানান, তারা সিটি করপোরেশন থেকে এই টোল আদায়ের লিজ নিয়েছেন। কার নামে লিজ নেয়া হয়েছে তা জানেন না ওই আদায়কারী। তিনি জানান, স্লিপে সব লেখা আছে। স্লিপে লেখা রয়েছে, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, পোস্তগোলা, শ্যামপুর, গুলিস্তান, জয়কালী মন্দির (সায়েদাবাদ সিটি) মতিঝিল, স্টপ ওভার টার্মিনাল সংশ্লিষ্ট যানবাহন হতে টোল ফি আদায়ের রশিদ।’ ২০ টাকা হারে এই টোল আদায় করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, এভাবে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে প্রতিদিন টোল আদায় চলছে।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে সিএনজি অটোরিকশা ও লেগুনা স্ট্যান্ড। এসব স্ট্যান্ড থেকেও সিটি টোলের নামে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। রাজধানীর সদরঘাটে রাস্তার ওপর বসানো হয়েছে কার স্ট্যান্ড। টার্মিনালের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত এই টার্মিনাল। সিএনজি অটোরিকশা, লেগুনা ও মাইক্রোবাসসহ ভাড়ায় চালিত গাড়িগুলো এখানে পার্কিং করে রাখা হয়। গাড়িপ্রতি ২০ টাকা দিতে হয় চাঁদাবাজদের। এখানে ১০-১২ ব্যক্তি রয়েছেন, যারা পার্কিং করা গাড়িগুলো থেকে টোলের নামে চাঁদা আদায় করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, তারা এই টাকা আদায় করে দেন। এরপর এই টাকা কোথায় যায় তা জানেন না তারা। তাদের জানামতে লঞ্চ টার্মিনালের পাশের এই স্থানটি লিজ নেয়া হয়েছে। রাস্তা কাউকে লিজ দেয়া যায় কি না তা জানতে চাইলে জবাব দিতে পারেননি ওই ব্যক্তি। ‘তিনি কিছু বলতে পারবেন না’Ñ এটাই তার শেষ বক্তব্য।
গোটা মতিঝিলে রয়েছে ছোট ছোট পার্কিং স্পট। এগুলোতে পার্কিং করতেও টাকা লাগছে। শাহেদ নামে এক ব্যক্তি বলেন, মতিঝিলে একটি অফিসে গিয়ে দেখেন ওই ভবনেরই কোনো পার্কিং ব্যবস্থা নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি বাধ্য হলেন রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করতে। আর রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করতে গিয়ে তাকে দিতে হয়েছে ২০ টাকা। শাহেদ বলেন, এভাবে রাস্তার ওপর গাড়ি পার্কিং অবৈধ। এর পরে ওই পার্কিং ভাড়া দিয়ে অর্থ আদায় আরেকটা অনৈতিক কাজ। তা জানা সত্ত্বেও তিনি বাধ্য হয়েছেন ২০ টাকা দিতে।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনেও দেখা গেল কয়েকজন যুবক প্রতিটি সিএনজিচালকের কাছ থেকে আদায় করছে চাঁদা। ধরিয়ে দিচ্ছে চাঁদা আদায়ের রসিদ। জানতে চাইলে জসিম নামে এক যুবক জানান, এই এলাকা পুরাটা লিজ নেয়া হয়েছে। এই এলাকার হর্তাকর্তারা এই টাকা নেয়।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/267633