১২ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৬:০৬

পারিবারিক কলহে ছয় বছরে ১৮৪৮ হত্যাকাণ্ড

রাজধানীর গুলশানে এক ভারতীয় নাগরিকের বাসায় কাজ করতেন ৩৯ বছর বয়সী রানী। তার স্বামী মিন্টু পেশায় একজন গাড়িচালক। চলতি বছরের ১০ই জুন মিন্টু তার স্ত্রী রানীকে ভারতীয় নাগরিকের গুলশান ৬৮ নম্বরের বাসার সামনে নামিয়ে দিতে যান। সেখানেই স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে পারিবারিক সমস্যা নিয়ে শুরু হয় কথাকাটাকাটি। একপর্যায়ে মিন্টু বেশ উত্তেজিত হয়ে একটি ছুরি দিয়ে রানীকে হত্যা করেন। এরপর তিনি নিজেই গিয়ে গুলশান থানায় আত্মসমর্পণ করেন।

এইতো কিছুদিন আগের ঘটনা। উত্তর বাড্ডার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন জামিল শেখ ও আরজিনা বেগম। তাদের নয় বছর বয়সী স্কুল পড়ুয়া নুসরাত নামের একটি মেয়েও ছিল। গত ২রা নভেম্বর ভোর ৬টার দিকে বাড্ডার ময়নানগরের তিন তলা বাসার ছাদ থেকে পুলিশ জামিল শেখ ও তার মেয়ে নুসরাতের লাশ উদ্ধার করে। পরে ওই দিন রাতেই জামিল শেখের ভাই শামিম শেখ বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। পরে পুলিশ নিহত জামিল শেখের স্ত্রী আরজিনা বেগমকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। নিজের পরকীয়া সম্পর্কের কথা তার স্বামী জেনে যাওয়ায় প্রেমিক শাহিনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করেন। আর বাবা হত্যার ঘটনা মেয়ে দেখে ফেলার কারণে ঠিক একই সময় মেয়ে নুসরাতকেও হত্যা করা হয়। ঠিক এভাবেই পারিবারিক কলহের জের ধরে গত ছয় বছরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১৮৪৮টি। বিশেষজ্ঞরা এসব পারিবারিক তুচ্ছ ঘটনায় হত্যাকাণ্ডের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। তারা মনে করছেন সামাজিকভাবে ন্যায়বিচার না থাকার জন্য এর প্রভাব ব্যক্তি জীবনে পড়ছে। আর ব্যক্তি থেকে সমাজ পরিবার পর্যন্ত গড়াচ্ছে। আবার অনেকের মতে, বর্তমান সময়ে মানুষ মানুষের সঙ্গে, পরিবারের সদস্যরা নিজেদের সম্পর্কগুলোকে মূল্যায়ন করছে না। এজন্য বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক খুব সহজে তৈরি হচ্ছে। যার কারণে সংসারে অশান্তি-হতাশা বাড়ছে। হতাশা চরমে পৌঁছালে তখনই অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) তথ্য অনুযায়ী গত ছয় বছরে পারিবারিক কলহে সারা দেশে নিহত হয়েছেন ১৮৪৮ নারী-পুরুষ। এরমধ্যে ২০১২ সালে পারিবারিক কলহে নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছে ১৭৭ ও আহত হয়েছেন ৪৩ জন নারী, ২০১৩ সালে নিহত হয়েছেন ১২৬ ও আহত হয়েছেন ৩৩ জন নারী, ২০১৪ সালে নিহত হয়েছেন ৩৮৯ ও আহত হয়েছেন ১৮২ জন নারী, ২০১৫ সালে নিহত হয়েছেন ৩৭৯ ও আহত হয়েছেন ৩২৭ জন নারী-পুরুষ, ২০১৬ সালে নিহত হয়েছেন ৩৮৪ ও আহত হয়েছেন ৩১৩ জন নারী-পুরুষ এবং ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩৯৩ ও আহত হয়েছেন ১০৫ জন নারী-পুরুষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামালউদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, সাধারণত ডিপ্রেশনের কারণেই পরিবারে কলহ তৈরি হয়। কখনো কখনো হতাশা-বিষণ্নতা থেকে হত্যাকাণ্ড ঘটে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে হত্যা পর্যন্ত গড়ায়। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেয়া দরকার। যেসব কারণে সাধারণত এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে সেসব দিক থেকে দূরে থাকতে হবে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা সোহেল মানবজমিনকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পারিবারিক কলহে হত্যাকাণ্ড আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। কারণ এখনকার পরিবারগুলোর মধ্য সম্প্রীতির অভাব রয়েছে। এছাড়া পারিবারিক বন্ধন থেকে দূরে চলে যাওয়া, প্রযুক্তির অপব্যবহার, সুষ্ঠু বিনোদনের অভাব, ভারতীয় সিরিয়াল থেকে অপসংস্কৃতির বীজ চলে আসার কারণে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটছে। এছাড়া বেকারত্ব, হতাশা ও পরকীয়ার কারণে স্বামী হত্যা করছে স্ত্রীকে। স্ত্রী হত্যা করছে স্বামীকে। এমনকি বাবা মা হত্যা করছে সন্তানকে আবার সন্তান বাবা মাকে। তিনি বলেন, পারিবারিক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে কিছু মামলার আসামিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এছাড়া এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত আসামির শাস্তি নিশ্চিত করতে দেশের গণমাধ্যমকে আরো বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে আসামির শাস্তি নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত গণমাধ্যমে ফলোআপ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, প্রথমত একটি পরিবার পরিচালনা করতে গিয়ে যে নৈতিকতা দরকার সে শিক্ষা আমরা সমাজ থেকে পাচ্ছি না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের স্কুল-কলেজে এসব বিষয়ে লেখাপড়া ও ওরিয়েন্টেশন করানো হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত করা হয়নি। এছাড়া একজন স্বামী যেমন জানে না সংসারে তার দায়িত্ব কি ঠিক তেমনি একজন স্ত্রীও জানেনা তার দায়িত্ব। নিজের দায়িত্ববোধ কি সেটা না জানার জন্য প্রতিনিয়ত একটা শূন্যতা ও দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত পরিবারের অভিভাবক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংসারের শান্তিবহির্ভূত কোনো কর্মকাণ্ড অর্থাৎ নিজেকে যদি পুঁজি বাজারের প্রভাবের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। সর্বশেষ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থান দ্রুত পরিবর্তনের জন্য কোনো অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়ানো। এই তিনটির মধ্যে যদি একটি অথবা তার অধিক কোনো বিষয়ে জড়িয়ে গেলে ব্যক্তির মধ্যে স্থিরতা ও নৈতিকতা নষ্ট হয়ে যাবে বলে মনে করেন এই অপরাধ বিজ্ঞানী। তিনি বলেন, অভিভাবক যখন নিজে ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠবে তখন পরিবার থেকে শৃঙ্খলাবোধ চলে যাবে। অশান্তির সৃষ্টি হবে। ঠিক তখনই হত্যাকাণ্ডের মতো বড় বড় ঘটনা ঘটে। পারিবারিক হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য অপরাধ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক মনে করেন, যারা নতুন সংসার জীবনে পদার্পণ করবেন তাদেরকে আগে ওরিয়েন্টেশন করতে হবে। যদিও আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নাই। এছাড়া সামাজিকভাবে আন্দোলন করতে হবে এবং সমস্যা তৈরি হলে শেয়ার করার মতো একটা জায়গা থাকতে হবে। এজন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কিছু প্রতিনিধি থাকা দরকার যারা পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে এর সঠিক সমাধান করতে পারেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মানবজমিনকে বলেন, মানুষের বোধশক্তি যখন অনেক লোপ পায় তখনই পারিবারিক হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকে। এছাড়া মাদকাসক্তির কারণে মানসিক বিপর্যয় ও বড় ধরনের কোনো আঘাত সহ্য করতে না পারলে এমনটি হয়। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়া ও সংসারের অভাব অনটন থেকেও কলহ তৈরি হয়। একপর্যায়ে সেটি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়ায়।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=91557