১১ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ১১:৪৫

সেই অস্ত্রগুলো কোথায় গেল

চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা

চট্টগ্রাম কলেজে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ১২ জুলাই ছাত্রলীগের দু'পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করে বাকলিয়ার বগারবিল এলাকার কথিত যুবলীগ কর্মী মোহাম্মদ সেলিম। গণমাধ্যমে সেই ছবিও ছাপা হয়। এরপর পাঁচ মাস পার হলেও চিহ্নিত ওই অস্ত্রধারীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। উদ্ধার হয়নি অস্ত্রও। এ নিয়ে কোনো মামলাও হয়নি। আরেক ঘটনায় গত ৬ অক্টোবর নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে হত্যা করা হয়। এ সময় পাঁচ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে লালখানবাজার এলাকার যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসী জাহেদ ও রুবেল। তাদেরও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তবে অধিকাংশ সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তরা গ্রেফতার হলেও হদিস মিলছে না অস্ত্রের।

এভাবে গত দুই বছরে অন্তত ১০টি সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডে অস্ত্রের ব্যবহার করেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনায় অস্ত্র উদ্ধারে নিষ্ক্রিয় পুলিশ। সংশ্নিষ্টদের অভিযোগ, রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজন।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন সমকালকে বলেন, 'অপরাধী যদি কোন সংগঠনের বড় নেতাও হয় তাকে ছাড় দেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পার পেয়ে গেলে সমাজে খুনোখুনি, সংঘাত ও অস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাবে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে পুলিশকে অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে।'
নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সালেহ মোহাম্মদ তানভীর সমকালকে বলেন, 'ঘটনার পর অপরাধীরা অস্ত্র লুকিয়ে ফেলে। ফলে আসামি গ্রেফতার হলেও অস্ত্র উদ্ধার সম্ভব হয় না। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ আন্তরিক। পত্রিকায় অস্ত্রধারীদের যেসব ছবি ছাপা হয়, তা অনেক সময় ঝাপসা কিংবা মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা থাকে। এ কারণে অপরাধীদের শনাক্ত করা যায় না।'

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৬ অক্টোবর সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়া বাসার সামনে খুন হন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস। তাকে খুন করে চলে আসার সময় পাঁচ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে নগরের লালখানবাজার এলাকার কথিত যুবলীগ কর্মী জাহেদুর রহমান জাহেদ ও চশমা রুবেল। এ ঘটনায় গ্রেফতার চারজনের মধ্যে মোক্তার হোসেন ও ফয়সাল আহমেদ পাপ্পু জবানবন্দিতে বলেছেন, জাহেদ ও চশমা রুবেলের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। এক মাস পার হলেও এ দু'জনকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। উদ্ধার হয়নি অস্ত্রও।
২০১৬ সালের ১৫ মার্চ সদরঘাট থানার পশ্চিম মাদারবাড়ি কামাল গেট এলাকায় নিজ বাড়ির সামনে খুন হন ঝুট ব্যবসায়ী আবদুল জাহেদ। নগরীর ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ ওরফে রয়েলের অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত তিনি। স্থানীয় ছাত্রলীগ নামধারী মো. আনিসের নেতৃত্বে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালের গত ৭ এপ্রিল পূর্ব মাদারবাড়ির সাহেবপাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গুলি করে খুন করা হয় মোহাম্মদ ইদ্রিস নামের এক যুবককে। এ ঘটনায় ইদ্রিসের বাবা বাদী হয়ে স্থানীয় সন্ত্রাসী হানিফ নামে এক যুবকসহ সাতজনকে আসামি করে মামলা করেন। এসব ঘটনায় ক'জন আসামি গ্রেফতার হলেও অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
সদরঘাট থানার পরিদর্শক মোহাম্মদ রুহুল আমীন সমকালকে বলেন, 'সুদীপ্ত হত্যায় আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। যাদের হাতে অস্ত্র ছিল, তাদের গ্রেফতার করতে পারলে অস্ত্রের উৎস সম্পর্কে জানা যাবে। প্রধান আসামিরা পলাতক থাকায় এখনও অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি।'

গত ২১ অক্টোবর রাতে নগরীর অফিসার্স ক্লাবের সামনে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগ নেতা এস এম জয়নাল উদ্দিন চৌধুরীর পায়ে গুলি করে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু। পুলিশ তাকে আটক করলেও ২১ ঘণ্টা পর ছেড়ে দেয়। এ ঘটনায় থানায় মামলাও হয়নি।
গত ২৮ এপ্রিল রাতে কোতোয়ালি থানার মোমিন রোডের ঝাউতলা এলাকায় তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে স্থানীয় কিশোর-তরুণদের দুই পক্ষ। একপর্যায়ে পিস্তল উঁচিয়ে প্রকাশ্যে গুলি চালায় সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী। এ ঘটনায় গত ২৫ মে তাকে গ্রেফতার করা হলেও উদ্ধার করা যায়নি অস্ত্র। পরে ২৬ জুন জামিনে বেরিয়ে আবারও স্বরূপ ধারণ করে ভয়ঙ্কর এ সন্ত্রাসী। গত ৯ আগস্ট বাল্যবন্ধু ইমরানুল করিম ইমনকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনায় কারাগারে আছে অমিত মুহুরী। গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বাকলিয়া এলাকায় ছাত্রলীগ নেতা তানজিরুল হকের পায়ে গুলি চালায় অমিত মুহুরী, মহিউদ্দিন জনি ও শাহজাহান।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে টেন্ডার নিয়ে নগর ভবনে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন ও যুবলীগ নেতা এ এম মহিউদ্দিনের অনুসারীরা। এ সময় নগর ভবনের বাইরে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনজন। একইভাবে ২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় মেয়রের বাসভবনের সামনে গোলাগুলি করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ। এসব ঘটনায়ও অস্ত্র উদ্ধার হইনি, মামলাও হয়নি।

২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর কোতোয়ালি থানার আলকরণ এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ইব্রাহিম মানিককে। ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল গুলির খোসা। এ ঘটনায় মোহাম্মদ রানা নামে একজনকে গ্রেফতার করা হলেও উদ্ধার হয়নি অস্ত্র।
নগর পুলিশের কোতোয়ালি অঞ্চলের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম সমকালকে বলেন, 'ঘটনার সময় সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র থাকে। যখন আসামি গ্রেফতার করা হয়, তখন আর তার কাছে অস্ত্র থাকে না। ঘটনার পর তারা যাদের কাছ থেকে অস্ত্র নেয়, তাদের কাছে জমা দিয়ে দেয়। ক'জন আসামিকে রিমান্ডে এনে অস্ত্রের উৎস জানতে চাইলেও পাওয়া যায়নি। সন্ত্রাসীরা কোন মাধ্যমে অস্ত্র পায় তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।'

http://www.samakal.com/whole-country/article/1711610/