দেশের মোট দারিদ্র্যের হার কমলেও কিছু জেলায় দারিদ্র্য বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের জরিপে দেখা গেছে, দেশের সাতটি জেলার অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। দীর্ঘদিন ধরেই এ জেলাগুলোর দারিদ্র্যের হার বেশি। এর আগে ২০১০ সালের এক জরিপে এসব জেলার অধিকাংশ মানুষ যে দরিদ্র তার তথ্য সরকারের কাছে ছিল। কিন্তু জেলাগুলোতে দারিদ্র্য নিরসনের তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এসব পিছিয়ে পড়া এলাকায় বাড়ানো হয়নি অর্থনৈতিক কার্যক্রম। এসব জেলার অধিকাংশ মানুষ দৈনন্দিন খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বস্ত্র খাতে প্রয়োজনীয় খরচ করতে পারেন না। প্রয়োজনীয় আয় না থাকায় ব্যয় করার সামর্থ্যও কম। অথচ গত ছয় বছর সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়েছে। প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব এলাকা পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ কর্মসংস্থানের অভাব। দারিদ্র্যপ্রবণ জেলাগুলোতে বছরের সব সময় মানুষের হাতে কাজ থাকে না। আর যেসময় কাজ থাকে, তখন মজুরিও কম পান। সরকার যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালাচ্ছে, সেখানেও অনিয়ম বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্য সমস্যাও তাদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। কর্মসংস্থানের অভাব এবং স্থানীয় চাহিদা ও সম্ভাবনা বিবেচনায় উদ্যোগ না নেওয়ায়
জেলাগুলো দারিদ্র্যের কবল থেকে বের হতে পারছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৬ সালে বিবিএস যে খানা আয়-ব্যয় জরিপ করেছে, তাতে প্রথমবারের মতো জেলাওয়ারি দারিদ্র্যের জরিপ করা হয়। জরিপে দেখা যায়, দেশের মোট দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে। কিন্তু কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, মাগুরা, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলার অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন। এসব জেলার দারিদ্র্যের হার
৫২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত। আরও চারটি জেলা রয়েছে যাদের দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশের বেশি। এর আগে ২০১০ সালে জরিপে বিবিএস জেলাওয়ারি দারিদ্র্যের হিসাব করেনি। অবশ্য জরিপে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে দেশের একটি দরিদ্র মানচিত্র (প্রভার্টি ম্যাপ) তৈরি করে বিবিএস। ওই মানচিত্রে দেখা যায় বরিশাল, চাঁদপুর, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ, শরীয়তপুর জেলার অর্ধেকের বেশি মানুষ গরিব। এই ছয় জেলার দারিদ্র্যের হার ছিলে ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ওই সময় দেশের মোট দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপেও আগের দারিদ্র্যপীড়িত তিনটি জেলা রয়েছে।
সাধারণত জরিপ করা হয় নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্নেষণ করে সরকার সম্ভাবনা কাজে লাগানো ও সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে নীতি গ্রহণ করে থাকে। সর্বশেষ জরিপে দারিদ্র্যপীড়িত জেলাগুলোর উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, সরকার যদি জরিপের তথ্য নিয়ে পরিকল্পনা না করে, তাহলে কেন এই জরিপ।
দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের ফোকাল পয়েন্ট পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম সমকালকে বলেন, দেশে এখনও দারিদ্র্যের কিছু পকেট রয়েছে। কোনো কোনো অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে এ অঞ্চলগুলোকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে যথেষ্ট পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি জানান, সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় 'অনুন্নত অঞ্চল বিশেষ তহবিল' গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। তবে এসব অঞ্চলের উন্নয়নে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে এসব অঞ্চলের দারিদ্র্য নিরসন হবে না।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, সামাজিক সুরক্ষা খাতে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের বেশ কিছু কর্মসূচি আছে। কিন্তু এ কর্মসূচির লক্ষ্য নির্ধারণ সঠিক হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে এলাকা চিহ্নিত করার কাজটি ঠিকভাবে হয়নি। অতিদরিদ্র এলাকাগুলোতে যে পরিমাণে সামাজিক সহায়তা পৌঁছানোর কথা ছিল, তা পৌঁছায়নি। আবার দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকায় যে পরিমাণ সহায়তা যাচ্ছে, তা গরিব জনগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন হচ্ছে না। খাদ্য ও নগদ সহায়তা বিতরণে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দুটোই রয়েছে। শুধু সামাজিক সুরক্ষার ওপর ভিত্তি করে টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন হবে না। বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে শ্রম আয় বাড়াতে হবে।
বিবিএসের সর্বশেষ জরিপে দেখা সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষের জেলা উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম। এক সময়ের মঙ্গাকবলিত এ জেলার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ এখনও গরিব। কুড়িগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান এই দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলাসহ মোট ১৬টি নদী এ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা ও নদীভাঙন এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে বড় বাধা। এ থেকে জনগণকে রক্ষার বিশেষ বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা দরিদ্র মানুষগুলোকে শুধু ভোটের সময়ই মনে করে। ২০১০ সালের হিসাবে কুড়িগ্রামের দারিদ্র্যের হার ছিল ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ছয় বছর আগেও দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্রপ্রবণ এলাকা হলেও সম্প্রতি জরিপে দেখা যাচ্ছে, উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হয়েছে। এদিকে দিনাজপুরে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ, জামালপুরে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ, কিশোরগঞ্জে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ ও মাগুরায় ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। আর বান্দরবানের ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ ও খাগড়াছড়ির ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। এসব জেলার অতিদারিদ্র্যের হারও জাতীয় অতিদারিদ্র্যের তুলনায় অনেক বেশি। ২০১০ সালের দারিদ্রের মানচিত্রে দিনাজপুরের দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ, জামালপুরের ছিল ৫১ দশমিক ১ শতাংশ, কিশোরগঞ্জের ছিল ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ এবং মাগুরার দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রত্যেকটি জেলায় অবনতি হয়েছে।
জরিপ বলছে, রাজধানী লাগোয়া জেলাগুলোর দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম। দেশের সবচেয়ে কম দারিদ্র্য নারায়ণগঞ্জে। শিল্পসমৃদ্ধ এ জেলার মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এর পরেই রয়েছে মুন্সীগঞ্জ। এ জেলার দারিদ্র্যের হার ৩ দশমিক ১ শতাংশ। ৩ দশমিক ৭ শতাংশ দারিদ্র্য নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পদ্মা পাড়ের জেলা মাদারীপুর। আরেক শিল্পসমৃদ্ধ জেলা গাজীপুরের দারিদ্র্যের হার ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। ফরিদপুরের দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ফেনীর দারিদ্র্যের হার ৮ দশমিক ১ শতাংশ। রাজধানী জেলা ঢাকার দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশ। ২০১০ সালে করা দারিদ্র্য ম্যাপে নারায়ণগঞ্জের দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬ দশমিক ১ শতাংশ। মুন্সীগঞ্জের ছিল ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। মাদারীপুরের দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ। গাজীপুরের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ, ফরিদপুরের ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ঢাকার দারিদ্র্যের হার ছিল ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ।
জরিপের তথ্য বিশ্নেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানী ও তার আশপাশের জেলাগুলোর দারিদ্র্য পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। এর অন্যতম কারণ এসব এলাকায় সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। গত কয়েক বছরে এগিয়ে আসা জেলাগুলোতে সরকার ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ করেছে। অর্থাৎ, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সুফল সব অঞ্চলে সমানভাবে বণ্টন হচ্ছে না।
পিকেএসএফের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আঞ্চলিক বৈষম্য অন্যান্য দেশেও আছে। রাস্তাঘাট, ভৌগোলিক অবস্থান এর একটি কারণ। আবার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অগ্রাধিকারে না থাকাও একটি কারণ। সুষম উন্নয়নের জন্য এসব জেলাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। জেলাগুলোর বিশেষ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।
গ্রামীণফোন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ইউনিসেফ বাংলাদেশের সমন্বয়ক থমাস জর্জ বলেন, বাংলাদেশের সব এলাকা একইভাবে এগোচ্ছে না। অনেক এলাকা এখনও পিছিয়ে রয়েছে। এজন্য স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও এসডিজির কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা উচিত।
মোগল আমলে উত্তরবঙ্গ ছিল দেশের অর্থনীতির মূল মেরুদণ্ড। সারা বাংলা থেকে যা খাজনা আদায় করা হতো, তার প্রায় অর্ধেকের বেশি আয় হতো রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চল থেকে। হিমালয়ের পাশে এবং সবচেয়ে সমতলভূমি হওয়ায় এখানের জমি ছিল সবচেয়ে উর্বর। সোনালি পাট, ধান আর তামাকের চাষে এ অঞ্চলের মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে বছরের খোরাক জোগাড় করে কিছু উদ্বৃত্তের মুখ দেখত। কিন্তু দেশ যখন কৃষি থেকে শিল্পের দিকে এগিয়েছে, তখন এ অঞ্চল আর গুরুত্ব পায়নি। সব অঞ্চলের জন্য সমানভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনা হয়নি। এখনও এসব অঞ্চলে শিল্পায়নের বিশেষ উদ্যোগ নেই।