১১ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:১৯

কানে কম শোনে ট্রাফিক পুলিশ!

দিনে কমপক্ষে ৫০ জন কানের রোগী আসেন রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে

ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল জহুরুল ইসলাম (৩৬)। তিনি দায়িত্ব পালন করেন রাজধানীর নাবিস্কো এলাকার তিব্বত মোড়ে। ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি লোপ পাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে জহুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘রাস্তায় দায়িত্ব পালন শেষে বাসায় গিয়ে টিভি দেখতে বসলে রিমোটে ভলিউম ৩০-৩৫ দিতে হয়। স্ত্রী চিৎকার দিয়ে বলেন, এত ভলিউম কেন? সাউন্ড কমাও। প্রথম প্রথম বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেও এখন বুঝি, আসলে আমি কানে কম শুনি। এজন্য স্ত্রীকে বিষয়টি না জানিয়ে টিভির দিকে শুধু চেয়ে থাকি।’
এছাড়া রাজধানীর মিন্টু রোডের ডিএমপি হেডকোয়ার্টার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে থাকা পঞ্চাশোর্ধ্ব মাকসুদুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন কোর্ট পুলিশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এখন পোস্টিং হয়েছে ট্রাফিক পুলিশে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কানেও ঠিকমতো শুনতে পাই না। চোখেও কম দেখি, কিন্তু করার কিছু নেই।’
ট্রাফিকে দায়িত্ব পালনকারীদের শ্রবণশক্তি লোপ পাওয়ার এ চিত্র শুধু জহুরুল ইসলাম অথবা মাকসুদুল আলমের নয়। এমন চিত্র উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের। এ তথ্য ওঠে এসেছে এক গবেষণায়। শব্দদূষণে সৃষ্ট ট্রাফিক পুলিশের কানের সমস্যার ওপর গবেষণা করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের নাক-কান-গলা ও হেড-নেক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হুসনে কমর ওসমানী। পুলিশের পক্ষ থেকে ‘সবুজ সংকেত’ না মেলায় তিনি গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করতে পারছেন না। তবে তার গবেষণার বেশকিছু তথ্য-উপাত্ত যুগান্তরকে জানিয়েছেন।

ডা. হুসনে কমর ওসমানী বলেন, ঢাকা মহানগরীতে কর্মরত ৩৫- ৬০ বছর বয়সী ১০০ জন রাস্তায় ডিউটি করেন এমন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য এবং অফিসে ডিউটি করেন এমন ৫০ জন ট্রাফিক পুলিশের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়। ২০০৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছর মেয়াদি এ গবেষণায় ওঠে এসেছে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের শ্রবণশক্তি দিন দিন লোপ পাওয়ার চিত্র। রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে সপ্তাহে ২ দিন উন্নতমানের মেশিন দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কান পরীক্ষা করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
ডা. হুসনে কমর ওসমানী বলেন, এসব পুলিশ সদস্য শব্দদূষণে আক্রান্ত। তারা কানে কম শোনেন এবং তাদের কানে শোঁ শোঁ শব্দ হয়। এসব পুলিশ সদস্য উচ্চরক্তচাপে ভোগেন। তারা যদি নিয়মিত কানের চিকিৎসা না করান, তাহলে অল্প বয়সে কানে একেবারে শুনতে পাবেন না বলেও আশঙ্কা করা যায়।’
এ চিকিৎসক আরও জানান, ট্রাফিক পুলিশের এসব সদস্য দিনে টানা ৮ ঘণ্টা কাজ করেন। সপ্তাহে তাদের কোনো অফিস ছুটি নেই, যার কারণে এ সমস্যা বেশি হচ্ছে। যারা টানা ৮ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করেন অথচ ১২ ঘণ্টার বেশি সময় বিশ্রাম পান না, তাদের কানের ক্ষতি বেশি হবে। আর এ কারণেই কলকারখানা এবং ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কানের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সব সময়ই থাকে।

ট্রাফিক পুলিশকে কীভাবে শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিক থেকে রক্ষা করা যায়- এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. ওসমানী যুগান্তরকে বলেন, আমি আমার গবেষণায় বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- হাইড্রোলিক হর্ন কার্যকর অর্থে নিষিদ্ধ করা, সব সময় রাস্তায় ডিউটি না করিয়ে অফিসেও ডিউটি করতে দেয়া এবং কানের মধ্যে ইয়ার প্লাগ ও ইয়ারমাফ ব্যবহার করে ডিউটি করা।
শুধু গবেষণার ফলই নয়, সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশের বক্তব্য এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। রাজধানীর ফার্মগেট, বিজয় সরণি, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী, নাবিস্কো, তিব্বত, সাতরাস্তার মোড়, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, পল্টন, গুলিস্তান, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের অর্ধশতাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বললে তারা প্রত্যেকেই তাদের কানের সমস্যার কথা জানান।

মগবাজার চৌরাস্তা মোড়। রাজধানীর ব্যস্ততম মোড়গুলোর একটি। সেখানে গত সপ্তাহে টানা তিন দিন (মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার) সরেজমিন দেখা গেছে, রিকশা-সাইকেল থেকে শুরু করে বাস-ট্রাক হেন যান নেই, যা এখান দিয়ে চলে না। রাতদিন গাড়ির আওয়াজে কান ঝালাপালা হয় এখানে। তার ওপর সিগন্যাল পড়লেই শুরু হয় ?এলোমেলো হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতা। বিকট আওয়াজের হর্ন সহ্য করে যানবাহন সামলাতে গলদঘর্ম হতে হয় ট্রাফিক পুলিশদের। তাদের বসার জন্য কোনো পুলিশ বক্সও নেই এই মোড়ে। সারা দিন ছোটাছুটি আর দাঁড়িয়ে থেকেই দায়িত্ব পালন করছেন তারা। মগবাজার চৌরাস্তা মোড়ে দায়িত্বরত রমনা জোনের ট্রাফিক পুলিশের একজন সার্জেন্ট যুগান্তরকে বলেন, চারপাশ থেকে আসা গাড়ির হর্নের শব্দেই আমরা কাহিল হয়ে যাই। মাথাব্যথা করে। ঠিকমতো ঘুম হয় না। আগের তুলনায় এখন কানেও অনেক কম শুনি।’ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিন্টু রোডের ডিএমপি হেডকোয়ার্টার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে ছিলেন পুলিশের এসআই আবুল কাশেম। তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৬টা থেকে এখানে ডিউটি শুরু করেছি। এখন বেলা ১১টা। এর মধ্যে কম করে হলেও ১০০ গ্রাম ধুলা খেয়ে ফেলেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘থানায় প্রায় ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করতে হতো। এজন্য ট্রাফিকে পোস্টিং নিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে ভুলই করেছি।’

এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের রমনা জোনের এসি আলাউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ট্রাফিক পুলিশের অধিকাংশ সদস্যই কানে কম শোনেন। তিনি বলেন, রাস্তায় সবচেয়ে বেশি সমস্যা গাড়ির হর্ন। হর্নের কারণে অনেক রোগের সৃষ্টি। তিনি আরও বলেন, ট্রাফিকে কাজ করলে এ সমস্যা হবেই।’
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, হাসপাতালে বিভিন্ন রোগীর মধ্যে দিনে কম করে হলেও ৫০ জন কানের রোগী এখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। পুলিশ হাসপাতালে নাক-কান-গলার চিকিৎসা করেন ডা. মনির উদ্দিন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমি মারাত্মক রোগীদের চিকিৎসা করিয়ে থাকি। আমার কাছে আসার আগে ইমারজেন্সি বিভাগ থেকেও অনেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, দিনে কম করে হলেও ৩০ জন কানের রোগীকে আমি চিকিৎসা করি।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, ৮৫ ডেসিবল মাত্রার শব্দ টানা আট ঘণ্টা শুনলে অথবা ১০০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ ১৫ মিনিট শুনলেই শ্রবণশক্তি ক্ষতির শিকার হবে। ব্যস্ত কর্মস্থলে ৮৫ ডেসিবল মাত্রার শব্দ টানা ৮ ঘণ্টা চলতেই থাকে। কাজেই এসব পরিবেশে যারা কাজ করেন, তাদের কানের অবস্থা খারাপ হচ্ছে।

ঢকার রাস্তায় কোথায় কেমন শব্দের মাত্রা, এর ওপর একটি পরিমাপ করেছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। তারা ঢাকার ৪৫টি স্থানে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করেছে। এর মধ্যে এয়ারপোর্ট, কুড়িল বিশ্বরোড, মহাখালী, ফার্মগেট, বাংলামোটর, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, পল্টন, গুলিস্তান, মতিঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেত, আজিমপুর, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব, কলাবাগান, ধানমণ্ডি, পান্থপথ, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর, কলেজ গেট, শ্যামলী, টেকনিক্যাল ও মিরপুর উল্লেখযোগ্য। জরিপ করা স্থানগুলো নীরব, আবাসিক, মিশ্র ও বাণিজ্যিক এলাকা। নীরব এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা ৮৩ দশমিক ৩ থেকে ১০৪ দশমিক ৪ ডেসিবল। আবাসিক এলাকায় দিনে ৯২ দশমিক ২ থেকে ৯৭ দশমিক ৮ ডেসিবল এবং রাতে ৬৮ দশমিক ৭ থেকে ৮৩ দশমিক ৬ ডেসিবল। মিশ্র এলাকায় দিনে ৮৫ দশমিক ৭ থেকে ১০৫ দশমিক ৫ ডেসিবল এবং রাতে ৮৫ দশমিক ৭ থেকে ১০৬ দশমিক ৪ ডেসিবল। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা ৯৪ দশমিক ৩ থেকে ১০৮ দশমিক ১ ডেসিবল। এ ছাড়া বাসের ভেতর শব্দের মাত্রা সামনে ৯৩ দশমিক ৬ থেকে ৯৫ দশমিক ২ ডেসিবল ও পেছনে ৮৪ দশমিক ৬ থেকে ৮৫ দশমিক ৪ ডেসিবল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শব্দের মাত্রা ৯৫ দশমিক ৮ থেকে ৯৬ দশমিক ৭ ডেসিবল। এ হিসাবে নীরব এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দেড় থেকে দুইগুণ বেশি। আবাসিক এলাকায় দিনে দেড়গুণ এবং রাতে শব্দের মাত্রার চেয়ে দেড় থেকে প্রায় দুইগুণ বেশি। মিশ্র এলাকায় দিনে দেড়গুণ বেশি, রাতে সেই মাত্রা দেড় থেকে দুইগুণেরও বেশি। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দেড়গুণ বেশি। জরিপে তারা শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিক হিসেবে মানুষের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা ঘটতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ট্রাফিক বিভাগ) সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে ট্রাফিক বিভাগের প্রায় ৬০০টি বিট রয়েছে। এসব বিটে প্রায় চার হাজার ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিরসনে দায়িত্ব পালন করছেন। দুই শিফটে চলে তাদের কার্যক্রম। প্রথম শিফট শুরু হয় ভোর সাড়ে ৬টা থেকে। চলে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত। আড়াইটা থেকে দ্বিতীয় শিফট শুরু হয়ে চলে রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত।

ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মসলেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ট্রাফিক পুলিশের কাজ রাস্তায়, এটি আমরা সবাই অবগত। একই সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা যে শারীরিকভাবে বিভিন্ন সমস্যায় ভোগেন, সেটিও জানা। তবে ট্রাফিকের কোনো সদস্য অসুস্থ হলে তাদের চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হয়। ট্রাফিক পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, উন্নত বিশ্বে ট্রাফিক সিগন্যাল লাইটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা এখনও হাতে করছি। তবে ভবিষ্যতে আমরাও সিগন্যাল লাইটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্ভব হব। এরই মধ্যে বাংলাদেশে ভিডিও মামলা শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা আরও বাড়ানোর জন্য ট্রাফিক পয়েন্ট অব ভিউ থেকে সিসি ক্যামেরা দরকার। তিনি জানান, ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে পুরো ঢাকা শহরে ট্রাফিকবান্ধব সিসি ক্যামেরা স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে ট্রাফিক পুলিশের কষ্ট অনেকাংশে কমে আসবে।’

https://www.jugantor.com/last-page/2017/11/11/170681