১১ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:১৫

চলছে না খাইরুলের সংসার

‘দুই বছর আগেও বেতনের টাকায় সংসার কোনো মতে টেনে নিয়ে যেতে পারতাম, এখন আর চলে না’

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে চলছে না খাইরুলের (৪৫) সংসার। খাবার তালিকায় করতে হয়েছে কাটছাঁট। তালিকা আগের চেয়ে অনেক ছোট করে আনার পরও পাঁচ সদস্যের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। পাঙ্গাশ অথবা ছোট মাছ ছাড়া গোশত অথবা অন্য কোনো সুস্বাদু খাবার তার বাসায় পাক হয় না বললেই চলে। সংসারে একটু স্বাচ্ছন্দ্য আনতে স্ত্রীকে মানুষের বাসায় কাজে পাঠাতে হচ্ছে। এ কাজটা খাইরুলের একেবারেই অপছন্দের ছিল। ক্ষুধার তাড়নায় তাকে এটাও করতে হয়েছে। ময়মনসিংহের ঈশ^রগঞ্জ উপজেলায় গ্রামের বাড়ি। থাকেন পূর্বরামপুরার তিতাস রোড এলাকায় স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে।
খাইরুল বনশ্রী আবাসিক এলাকার একটি দোকানে দারোয়ানের কাজ করেন। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ডিউটি। মাঝখানে দুপুরে এক ঘণ্টা পাওয়া যায় খাওয়ার জন্য। দারোয়ানের কাজ হলেও তাকে সবই করতে হয়। মাল নামানো, দোকানে অন্যান্য কর্মচারীদের সাথে মাল ঠিক করে রাখা, ক্রেতাকে রিকশায় অথবা গাড়িতে মাল তুলে দেয়া সবই করতে হয়। এত কিছু করার পর বেতন মাত্র সাত হাজার টাকা।

খাইরুল জানান, মাসে কমপক্ষে ৬০ কেজি চাল লাগে সংসারে। খরচ কমানোর জন্য কিছু আটাও কিনি। চাল ও আটার পেছনে মাসে কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার টাকা চলে যায়। আমার বেতনের অবশিষ্ট থাকল সাড়ে তিন হাজার টাকা। এ টাকা দিয়ে পুরো মাস চালাতে হয়। আমার তিন ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিয়েছি। সরকারি স্কুল বলে বেতন লাগে না, বই কিনতেও টাকা লাগেনি। কিন্তু পোশাক, কাগজ-কলম ইত্যাদি তো দিতে হয়। এ ছাড়া রয়েছে অসুখ-বিসুখ। আমরা বংশগত উচ্চ রক্তচাপের রোগী। প্রতিটি ট্যাবলেট কিনে খাই আট টাকায়। আমার পেছনেই মাসে খরচ হয় কমপক্ষে সাত শ’ টাকা। আরো নানা ধরনের অসুখ আছে। ছেলেমেয়েদের জ¦র-ঠাণ্ডা অথবা সর্দি লেগেই থাকে। এসবের পেছনে টাকা লাগে।
খাইরুল জানালেন, দুই বছর আগেও আমার বেতনের টাকায় সংসার কোনো মতে টেনে নিয়ে যেতে পারতাম, এখন আর চলে না। বাধ্য হয়ে বউকে মানুষের বাসায় ‘বুয়ার’ কাজে দিতে হয়েছে। খাইরুল জানান, আমি লেখাপড়া করিনি বলে এখানে ছোট কাজ করি। আমার পুরো পরিবার উচ্চশিক্ষিত, তাদের কেউ কেউ ঢাকায় ভালো চাকরি করেন। ছোট কাজ করি বলে তাদের কারো বাসায় যাই না। নিজে তো কিছু করতে পারলাম না। ছেলেমেয়েদের কষ্ট করে হলেও লেখাপড়া শেখাবো। তারা হয়তো কিছু করবে। সে জন্য বউ মানুষের বাড়িতে যায় কাজ করতে।

খাইরুল বললেন, আগে তো প্রতি বেলার খানায় কমপক্ষে দুইটি সবজি থাকত। এখন একটিতে নামিয়ে এনেছি। প্রতিদিন মাছ কিনতে পারি না। আগে বিশ টাকায় ছোট মাছের এক ভাগ পাওয়া যেত, এখন ভাগ ছোট হয়ে গেছে। একবার তরকারিতে দিতে হলে কমপক্ষে ৪০ টাকার ছোট মাছ লাগে। তাই নিরামিশ খাই। অনেক দাম তাই মওসুমের নতুন কোনো সবজি কিনি না। দাম কমলে কিনি। কলা ছাড়া আমার বাসায় কোনো ফল আসে না। আমার ছেলেমেয়েরা গত এক বছরেও কমলা অথবা আঙ্গুর অথবা আপেলের মুখ দেখেনি। দাম কমলে পেয়ারা খাই, আমড়া খাই। ঈদের ছুটিতে বাড়ি গেলে কলা নিয়ে আসি।
পূর্ব রামপুরার তিতাস রোডের বাজারে খাইরুল গতকাল শুক্রবার বাজার করতে এলে কথা হয় এ প্রতিবেদকের সাথে। খাইরুল বললেন, এই যে বাজারে লালশাক, মুলাশাক, লাউশাক অথবা বরবটি, লাউ অথবা বেগুন দেখছেন, এখন পর্যন্ত আমি মুলাশাক ছাড়া আর কিছুই কিনতে পারিনি। খাইরুল বলেন, ‘জিনিসপত্রর অত দাম, কিবায় কিনবাম? চাউল কিন্যাইত ট্যাহা শেষ। আর শাক কিনবাম কিদ্যা (কি দিয়ে)? বড় মাছত কিনতাম পারি না। খাই খালি ইছা মাছ আর পাঙ্গাশ।’
খাইরুল বনশ্রীর একটি চালের দোকানে প্রতি রাতে দুই কেজি করে চাল কিনতেন। এখন প্রতি রাতে দেড় কেজি করে চাল কিনেন। খাইরুল বলেন, চাউলের দাম বেড়েছে কিন্তু আমার বেতন বাড়েনি। পেঁয়াজ কিনতে গেলে শরীরে জ¦র ওঠে। দুধ যে কি জিনিস আমার সন্তানরা চোখেও দেখে না। খাইরুল বললেন, কেমনে বাঁচবাম, কেমনে ঢাহা শহরে থাকবাম? সরকার কি গরিবদের লাইগ্যা একটা কিছু করতে পারে না? নাখায়া কি গরিব মানুষ মইর্যাগ যাইব?

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/267337