১১ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:১৪

নগরীতে অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য থামছে না

ঢাকা মহানগরীতে সিটিং সার্ভিসের নামে বাস-মিনিবাসে চলছে চরম নৈরাজ্য। এই নৈরাজ্য কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে নানা কথা বলা হলেও কিছুই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মালিকরা ইচ্ছামত জনগণের পকেট কাটছে। বিশেষজ্ঞরা এই অবস্থাকে নৈরাজ্য বলছেন। তাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, নগরীতে ৯৬ শতাংশ বাস-মিনিবাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, নির্ধারিত ভাড়ায় তো দূরের কথা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও বাস-মিনিবাসে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। আর সিটিং সার্ভিসের নামে চলছে পরিবহন নৈরাজ্য। এসব নৈরাজ্য ও অনিয়ম বন্ধে সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।

আয়াত পরিবহনে রাজধানীর মিরপুর গোলচক্কর অথাৎ মিরপুর-১০ নম্বর থেকে মগবাজার পর্যন্ত আসছিলেন একটি জাতীয় পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক। তার কাছ থেকে ভাড়া নেয়া হয় ২৫ টাকা। আবার একই ভাড়া নেওয়া হয় মিরপুর-১০ নম্বর (বাসের যাত্রা শুরু চিড়িয়াখানা গোলচক্কর থেকে) হতে মৌচাক, মালিকবাগ এবং কমলাপুর পর্যন্ত। তার অভিযোগ, মিরপুর ১০ থেকে মগবাজার পর্যন্ত এবং মিরপুর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত একই ভাড়া হয় তাহলে যাত্রীদের কাছ থেকে ৪ কিলোমিটারের ভাড়া কম নেয়া হয় নয়তো বেশি নেয়া হয়। ওই সাংবাদিকের মত রাজধানীতে হাজার হাজার যাত্রীর একই অভিজ্ঞতা। রফিকুল ইসলাম নামের এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীর অভিযোগ গাজীপুর থেকে সায়েদাবাদ রুটে চলাচলকারী অনাবিল পরিবহনেও অতিরিক্ত ভাড়ার বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রী সিটিংয়ের নামে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিটিং সার্ভিসের নামে চলছে পরিবহন নৈরাজ্য। এসব নৈরাজ্য ও অনিয়ম বন্ধে সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।
সরকার কর্তৃক বাস ও মিনিবাসে ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। ঢাকা মহানগরীতে বাসভাড়া (ব-সিরিজ) প্রতি কিলোমিটারে ১.৭০ টাকা ও মিনিবাস ভাড়া (জ-সিরিজ) প্রতি কিলোমিটারে ১.৬০ টাকা। সর্বনিম্ন ভাড়া ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত বড় বাসে ৭ টাকা, মিনিবাসে ৫ টাকা হলেও নগরীতে চলাচলরত ৯৬ শতাংশ বাস-মিনিবাস অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের সঙ্গে জড়িত। সিটিং, গেটলক, ডাইরেক্ট, নগর পরিবহনে চলছে চরম নৈরাজ্য। এসব বাসে উঠলেই ১০-১৫ টাকা দিতে হবে। আপনার গন্তব্য যেখানেই হউক না কেন? এসব বাস-মিনিবাস সরকার নির্ধারিত ভাড়া বা সর্বনিম্ন ভাড়া কিছুই মানে না। নামমাত্র কিছু বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয় না। বিভিন্ন বাস কোম্পানি কর্তৃক তাদের পরিবহনের জন্য কোম্পানি কর্তৃক প্রণীত ভিন্ন ভিন্ন ভাড়ার চার্ট দিয়ে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বেশিরভাগ বাস-মিনিবাসে ভাড়ার তালিকা নেই। এ কারণে ভাড়া আদায়ে চরম নৈরাজ্য হচ্ছে। প্রতিবাদ করা হলে যাত্রীরা লাঞ্চিত হন। পরিবহনে নৈরাজ্য ঠেকাতে বিশেষজ্ঞরা নানা কৌশলের কথা বললেও সংশ্লিষ্টরা এগুলো কানে নেন না। সরকারের মন্ত্রীরা মাঝেমধ্যে গরম বক্তব্য দিলেও তা আর আলোর মুখ দেখে না।
বাসের বাইরে সিটিং গেটলক, ডাইরেক্ট লেখা থাকলেও বাসে গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হয়। আবার যেখানে সেখানে যাত্রী উঠানামাও করা হয়। সিটিং বাসে সিটের বেশি যাত্রী উঠানো নিষিদ্ধ থাকলেও দাড় করিয়ে অনেক যাত্রী নেয়া হয়। সিটে বসে থাকা যাত্রীরা এর প্রতিবাদ করলে বাসের কর্মচারীরা দুর্ব্যবহার করে থাকে। এসব দেখার জন্য কোন সংস্থা না থাকায় মহানগরে পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়।

কয়েকদিন আগে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে একটি পর্যবেক্ষণ কমিটি কাজ করে। পাঁচ সদস্যের এই দল গত তিন মাস নগরীতে চলাচল করা ১ হাজার ৩০টি বাস-মিনিবাসের যাত্রীসেবা, গাড়ির অবস্থা, ভাড়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থাসহ সার্বিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি চালক, হেলপার, যাত্রী, মালিক সমিতি, শ্রমিক সংগঠন, ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে একটি রিপোর্ট তৈরি করে। তাতে দেখা যায় নগরীতে ৯৬ শতাংশ বাস-মিনিবাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যাত্রী হয়রানি থামাতে সমিতির পক্ষ থেকে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয় না। সংগঠনটির পক্ষ থেকে দেওয়া সুপারিশগুলো হলো- সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় নির্ধারিত স্টপ অনুযায়ী সিটিং সার্ভিস বাস-মিনিবাস পরিচালনা, ভাড়ার অংক ও দূরত্ব উল্লেখ করে টিকিট দিয়ে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করা, ভাড়ার সুনির্দিষ্ট তালিকা বাসে ও বাস কাউন্টারে প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা, রাস্তায় মোট কয়টি স্টপ থাকবে সরকার-মালিক-শ্রমিক-যাত্রী প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা, চালকদের কাছে দৈনিক চুক্তিতে বাস ইজারা দেয়া বন্ধ করা, বাসে অননুমোদিত আসন বাদ দেয়া, প্রতিটি সিটিং সার্ভিস বাসে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী যাত্রী ও অসুস্থদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষণ করা, অনুমোদন নেই এমন সিটিং সার্ভিসের বাসের মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, সিটিং সার্ভিসের বাসের আলাদা রঙ দেয়া, সিটিং সার্ভিসের বাসে নির্ধারিত স্টপেজের বাইরে রাস্তার মাঝপথ থেকে যাত্রী নেয়া বন্ধ করা, বিশেষ করে সিটিং সার্ভিসের বাস রুট পারমিটের শর্তানুযায়ী চলাচল নিশ্চিত করা, যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে সরকার-মালিক-শ্রমিক-যাত্রী প্রতিনিধির সমন্বয়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করা এবং গঠিত কমিটির সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবায়ন হলো তা জানাতে নির্দিষ্ট সময় পরপর গণশুনানির আয়োজন করা।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ মনে করেন, ঢাকা গণপরিবহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা জাতীয় উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। তাই গণপরিবহনকে প্রাধান্য দিতে হবে সরকারের। সিটিং সার্ভিস ও লোকাল সার্ভিস উভয় ক্ষেত্রে নৈরাজ্য চলছে। দ্রুত এই নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে। না হলে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়তে থাকবে আর যাত্রীসেবা দিন দিন খারাপ হবে।

http://www.dailysangram.com/post/307178