১১ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:০৭

প্রিয়নদী টাঙ্গন তুমি হারিয়ে যাচ্ছো কেন!

শৈশবে আমি যে টাঙ্গন দেখেছি, সে টাঙ্গন এখন কোথায়! হ্যাঁ, উত্তরের জনপদ ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত এক সময়ের প্রমত্তা টাঙ্গন নদীর কথা বলছি। এ নদীতে কোনও কালে নাকি জাহাজ চলেছিল সাইরেন বাজিয়ে। আমরা সেসব দেখিনি। তবে বড় বড় নৌকো চলতে তো দেখেছি প্রায় ৫০ বছর আগে। ওই নৌকোও আর চলে না টাঙ্গনে।
অনেকে অবশ্য টাঙ্গনকে নদী না বলে নদ বলেন। তবে আমি এব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করে আসছি কয়েক দশক যাবৎ। ভূগোল বইয়ের লেখক-সংকলকরা নদী ও নদের সংজ্ঞা নির্দেশ করলেও সবক্ষেত্রে তা প্রযুজ্য নয়। টাঙ্গনের বেলায়তো নয়ই। তবে যেগুলোর নামই পুরুষবাচক সেগুলো নদ হতেই পারে। যেমন: ব্রহ্মপুর, সিন্ধু, সাঙ্গু, ভৈরব।

উদাহরণ হিসেবে একটা কথা বলতে চাই। যেসব মেয়ে খুব চঞ্চল, ডানপিটে এবং দুরন্তপনা করে বেড়ায় গ্রেটার দিনাজপুর অঞ্চলে তাদের বলা হয় ‘টাঙ্গনঘাটি’। পাড়া-মহল্লা, হাটবাজার তথা ঘাটেঘাটে ঘুরে বেড়ায় যে-মেয়েরা তাদের কপালে এ অভিধা জোটেই। এছাড়া ‘টাঙ্গন’ শব্দটাও আমার কাছে স্ত্রীবাচক মনে হয়। তাই টাঙন নদ নয়, নদীই। এছাড়া দেশের মানচিত্রেও টাঙ্গনকে নদী বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই টাঙ্গনকে যারা ‘পুরুষ’ বানাতে চান তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্বৈরাচারী মানসিকতার তাবেদার ব্যতীত আর কী!
ঠাকুরগাঁওয়ের সাংবাদিক তানভীর হাসান তানু জানিয়েছেন, টাঙ্গন নদী ঘিরে গড়ে উঠেছে ঠাকুরগাঁও শহর। এ নদী জবরদখল হয়ে পরিণত হয়েছে এখন মরাখালে। শহররক্ষা বাঁধের ওপর নির্মাণ হচ্ছে বহুতল বাড়ি-ঘর। এক সময়ের প্রমত্তা এ নদীতে এখন বর্ষাকালেও তেমন আর পানি থাকে না বলা যায়। শুধু টাঙ্গন নয়, একই অবস্থা ঠাকুরগাঁওয়ের ওপর দিয়ে বয়ে চলা আরও ১১টি নদীর।

লাছি বা নালার মতো বয়ে যাওয়া টাঙ্গন নদী দেখে বোঝার উপায় নেই এটি এক সময়কার প্রমত্তা টাঙ্গন। এর তীরে গড়ে উঠেছিল ঠাকুরগাঁও শহর। এখানে এসে ভিড়তো সওদাগরী বড় বড় নৌকো। টাঙ্গন নদীর তীরে এখন গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। নদী দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে স্থাপনা। শহররক্ষা বাঁধের ওপর সম্প্রতি নির্মাণ করা হয়েছে বেশকিছু পাকা বাড়িঘর। ফলে হুমকির মুখে এখন এটিও।
স্থানীয় প্রভাবশালীরা কোনওপ্রকার নিয়মনীতি ছাড়াই নদী দখল করে বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করছেন। একের পর এক নদী দখল করে অবৈধ স্থাপনা তোলাতে জেলার নদীগুলো ভরাট হয়ে মরে যাচ্ছে। প্রায় সবনদী এখন অনাব্য হয়ে পড়েছে। টাঙ্গনসহ কুলিক, তিরনাই, সেনুয়া সব নদী দখল করে চাষাবাদ চলছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনও মাথাব্যথা নেই। স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি এখনই এ দখলতা-ব ঠেকানো প্রয়োজন। নইলে নদীগুলো অস্তিত্বসঙ্কটে পড়বে। এক সময় সাধারণ মানুষও নদী দখল করে স্থাপনা তোলার কাজ শুরু করে দেবেন। অবশ্য নদীর তীরে বসতবাড়ি বা স্থাপনা যারা তৈরি করেছেন তাদের দাবি, যেসব জমিতে তারা ঘর-বাড়ি নির্মাণ করছেন সেগুলো তাদের কেনা।
নদীরক্ষা আইনে উল্লেখ রয়েছে, নদীর দুই পাড়ের ৩০ ফুট করে জায়গা নদীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সেই আইন কেউ মানছেন না। আইন অনুসারে ‘পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা’র মাধ্যমে সকল নদী, জলপথ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করবার ক্ষমতা বাপাউবো-এর ওপর অর্পণ করা হয়। জাতীয় পানিনীতি এবং জাতীয় পানি পরিকল্পনার আলোকে পানিসম্পদ সেক্টরের প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রমগ্রহণের দায়িত্বও এ সংস্থাকে দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখন পর্যন্ত ঠাকুরগাঁওয়ের বিপন্নপ্রায় নদীসমূহের সুরক্ষায় প্রশাসনের কোনও ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনের নিশ্চলতা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বারবার নদীরক্ষায় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসনিক কাজে কোনও সাফল্য নেই বললেই চলে। ২০০৯ সালে দেশের উচ্চ আদালত নদীরক্ষায় একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করে; যাতে বলা হয়, ‘নদীরক্ষার প্রথম কাজ হিসেবে নদীর সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্ত করতে হবে’। এলক্ষ্যে নদী টাস্কফোর্স গঠন করা হলেও গত ৭/৮ বছরে একটি নদীও দখলমুক্ত হয়নি। বরং অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নদীর বিশাল আয়তনের জমি ছেড়ে দিয়ে ভুল স্থানে খুঁটি বসিয়ে দখলদারদেরই বৈধতা দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ একটি নদীরক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও এর কোনও নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তাই একটি নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিশালী নদী কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে।
দেশের পরিবেশ ও জনস্বার্থে নদীবান্ধব নীতির কার্যক্রম গ্রহণ এবং সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষ থেকেই নদীদখল, দূষণ এবং ধ্বংসের সকল কর্মকা- এখনই বন্ধ হওয়া জরুরি বলে অভিজ্ঞরা মনে করছেন।
উত্তরাঞ্চলসহ দেশের নদ-নদীগুলোর পানি মারাত্মকভাবে হ্রাস পাওয়ায় নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষি, মৎস্য, পশুসম্পদ, শিল্প-কারখানা, মানুষের জীবনযাত্রা, প্রকৃতি ও কৃষি হুমকির মুখোমুখি। উল্লেখ্য, আমাদের দেশ নদীপ্রধান। তাই নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। নদীর অস্তিত্বই এদেশ এবং জাতির অস্তিত্ব। একথা আমাদের সবার মনে রাখা জরুরি।
ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, নওগাঁ, গ্রেটার রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রকৃতি এখন চরম ভাবাপন্ন। গ্রীষ্মকালে গরম বেশি পড়ে। শীতকালে বাড়ে শীত। তাপমাত্রা নেমে যায় ৫ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। শীতকালে রাত থেকে সকাল ১০/১১ টা পর্যন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে সমগ্র এলাকা। সূর্যের মুখ তেমন দেখা যায় না। আবার গ্রীষ্মে আবহাওয়া থাকে গরম। যেন মরুভূমির উষ্ণতা অনুভূত হয়। পানির স্তর নিচে নেমে যায়। ব্যাহত হয় সেচকাজ। টিউবওয়েলে খাবার পানি পেতেও কষ্ট হয়।
তানভীর হাসান তানু আরও লেখেছেন, ঠাকুরগাঁওসহ উত্তরাঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষের দাবি অচিরেই বিপন্ন নদীগুলো দখলমুক্ত করা দরকার। প্রয়োজনীয় খননকাজ সেরে নদীগুলোকে আবারও নাব্য করে পূর্বের প্রমত্ততা ফিরিয়ে দেয়া জরুরি। আর এব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরি বলে এলাকাবাসী মনে করেন।
উল্লেখ্য, এলাকায় আপনজন বলেতো আমার তেমন কেউ নেই। আছে কেবল বহু স্মৃতিবিজড়িত একটা নদী। যার নাম টাঙ্গন। এ নদীটা দেখেইতো আমি বারবার যেতে চাই আমার জন্মভিটেতে। যদিও সে সৌভাগ্য হয়ে ওঠে না প্রায়শ। প্রিয়নদী টাঙ্গনের এমন অন্তিম অবস্থা দেখতে হবে তা ভাবতেও বুকটা যেন ককিয়ে ওঠে। নদীটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় শুকনো মওসুমে পানি থাকেই না বলা চলে। কয়েক জায়গায় বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রেখে মাছের চাষ করছেন কেউ কেউ। এছাড়া নদীর মাঝবুকে এখন ইরি-বোরোর চাষ হয়। যে নদীর বুকে চাষাবাদ হয়, সেটাকে কি নদী বলা যেতে পারে? নিশ্চয়ই না। শুধু টাঙ্গনই নয়, এ অঞ্চলের সব নদীর একই দশা এখন। শুকনো মওসুমে ঝিরিঝিরি ধারায় কোনও কোনওটিতে পানি বইলেও অনেকগুলোই একদম শুকিয়ে গেছে। তবে বর্ষায় উত্তরের বাঁধভাঙা পানির তোড়ে প্রায় নদীতে বন্যা হয়। ডুবে যায় ফসল এবং ভেসে যায় মানুষের ঘর-বাড়ি। যেমন এবার বন্যায় দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। মানুষ এখনও তার ধকল সামলাতে পারেনি।
আমি যখন চার কি পাঁচ বছরের, সে সময় একদিন টাঙ্গনের লীলাঘাটে স্নান করতে গিয়ে ডুবে গিয়েছিলেন আমার মা পার্বতী সিংহরায়। অন্যরা জাল ফেলে মাকে উদ্ধার করে। কিন্তু সেই নদী এখন আর নেই। গ্রীষ্মকালে নদীতো নয়, যেন খাঁড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ক্ষুদ্র নালা আর কী!

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোটনদী’ কবিতাটা স্কুলপাঠ্য ছিল। কবি লিখেছিলেন:
‘আমাদের ছোটনদী চলে বাঁকেবাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সেই ছোটনদীতে বোশেখে আর হাঁটুজলও থাকে না। আগেই বলেছি, উত্তরের বাঁধভাঙা পানিতে বন্যা না এলে টাঙ্গনে ভরা আষাঢ়-শ্রাবণেও হাঁটুজল পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে কোনও কোনও বছর। তাই কাব্য করে নয়, আক্ষেপ করে বলতে হয়, ‘প্রিয়নদী টাঙ্গন তুমি হারিয়ে যাচ্ছো কেন! আমার মতো কেন তোমার যৌবনও উবে গেল!’ হ্যাঁ, টাঙ্গনের জন্য আমি কাঁদি। হয়তো আমার মতো আরও কেউ কাঁদে!

শুধু টাঙ্গন বলি কেন, উত্তরের কুলিক, তিরনাই, ঢেঁপা, সেনুয়া, করতোয়া, আত্রাই, মহানন্দা, কাঞ্চন, পুনর্ভবা, ধরলা, ঘাঘটসহ সব নদীরই এখন মরণদশা। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা অদূর ভবিষ্যতে দেশের উত্তরাঞ্চল থেকেই মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। একশ’ বছর পর হয়তো দেশের অনেক নদ-নদীরই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই এখনই বিপন্ন নদীগুলো রক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময় যারা ক্ষমতায় আরোহণ করেন তারাতো গদিরক্ষা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। নদীরক্ষার চিন্তা করবেন কখন?

http://www.dailysangram.com/post/307096