১০ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৬

নর্থ সাউথের শিক্ষক মুবাশ্বার কোথায়-কারা তুলে নিল

ড. মুবাশ্বার হাসান সিজার খুব স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতেন। তার কোনো শত্রু নেই, গণমাধ্যমের কাছে পরিবারের দাবি এমনটাই। তাহলে প্রশ্ন জাগে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথের এই শিক্ষক এখন কোথায়? কি অবস্থায় আছেন? কারা তাকে তুলে নিয়ে গেলো? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও সংস্থা তাকে আটক করেছে, নাকি কেউ অপহরণ করেছে? দু‘দিন পেরিয়ে গেলেও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরিবারের উদ্বিগ্ন সদস্যদের দাবি, অপহরণ করা হলে মুক্তিপণ চাওয়ার কথা। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সময়ের মধ্যেও মুক্তিপণ চেয়েও ফোন করেনি অপহরণকারীর দল। পরিবার ও স্বজনরা তার খোঁজে ব্যকুল। কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। তাদের একটিই চাওয়া মুবাশ্বার যেন ফিরে আসে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, তারা মুবাশ্বারের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখছেন। কেউ তাকে তুলে নিয়ে গেছে, নাকি নিখোঁজ হওয়ার পেছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে, তা খুঁজে দেখছেন তারা।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন সিজার। এ কারণে তিনি বাসায় সিসি ক্যামেরাও স্থাপন করেছিলেন। তিনি জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে গবেষণা করতেন।

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি অনুসন্ধান করছি। কোনও আপডেট তথ্য পাওয়া গেলেই বিষয়টি জানাবো।’
মুবাশ্বারের পরিবার, বন্ধু ও স্বজনেরা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে কিছুটা আতঙ্কে ভুগছিলেন তিনি। সপ্তাহখানেক আগে অজ্ঞাত দুই যুবক ছাত্র পরিচয় দিয়ে তার বনশ্রীর বাসায় ঢোকার চেষ্টা করেছিল। একারণে বাসায় সিসিটিভি ক্যামেরাও লাগিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কেন তাকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা অনুসরণ করতে পারে, সে বিষয়ে কেউ বিস্তারিত জানাতে পারেননি।
স্বজনরা জানান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এটুআই প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। নিখোঁজ হওয়ার আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবনে এটুআই প্রকল্পের একটি মিটিংয়ে গিয়েছিলেন। মিটিং শেষ করে আইডিবি ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নিখোঁজ হন। ব্যক্তিগত গাড়ি নষ্ট হওয়ার কারণে তিনি সিএনজি বা উবারের গাড়িতে চলাফেরা করতেন। আইডিবি ভবন থেকে বেরোনোর আগে তিনি উবারের গাড়ি কল করেছিলেন বলেও জানা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, ড. মুবাশ্বার হাসান সিজারের সর্বশেষ অবস্থান ছিল আগারগাঁও আইডিবি ভবন এলাকাতেই। সর্বশেষ মঙ্গলবার ৬টা ৪১ মিনিটে তিনি নিজের মোবাইল থেকে কল করেছিলেন। ৬টা ৪৫ মিনিটে তার নম্বরটি বন্ধ হয়ে যায়।
বন্ধু ও স্বজনরা বলছেন, ড. মুবাশ্বার বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এছাড়া, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় সম্পৃক্ততাও তার গবেষণার বিষয় ছিল। এসব কারণে তৃতীয় কোনও পক্ষ মতবিরোধের জেরে তাকে তুলে নিতে পারে বলেও অনেকে ধারণা করছেন। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
মুবাশ্বারের বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মোতাহার হোসেন বলেন, ‘সে এমনি এমনি নিখোঁজ হয়নি। এর নেপথ্যে কোনও কারণ অবশ্যই আছে।’ তিনি যে কোনও মূল্যে ছেলেকে ফেরত পেতে চান।

মোতাহার হোসেন বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকালে ৪টার দিকে মোবাইল ফোনে মুবাশ্বারের সঙ্গে কথা হয়। তখন সে বলেছিলো- কিছু কাজ বাকি আছে, সেগুলো শেষ করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাসায় ফিরবে। কিন্তু সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়’। ‘আমরা মনে করেছি, মুবাশ্বারের ফোনের চার্জ ফুরিয়ে গেছে। পরে রাত ১২টা পর্যন্ত কোনো খোঁজ না পেয়ে থানায় নিখোঁজ সংক্রান্ত একটি জিডি করি’। ‘মুবাশ্বারের এক সহকর্মীকে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবগত করার পর মুবাশ্বারের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের প্রধান আমাকে ফোন করে সমবেদনা জানান’। ছেলে নিখোঁজের বিষয়টি র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যা ব-৩) অবগত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মুবাশ্বার বছর তিনেক আগে বিয়ে করলেও এক বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে তার। পারিবারিক কোনও বিরোধের জের ধরে তাকে কোনও পক্ষ অপহরণ করতে পারে কিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা সেই বিষয়টিও খোঁজ-খবর করছেন। তবে পারিবারিক বিষয়ে ড. মুবাশ্বারের পরিবারের সদস্যরা কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

বছরখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কেউ একজন ড. মুবাশ্বারের বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচার করেছিলেন বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মামলা করার কথাও বলেছিলেন। সেই সূত্রে পুরনো কোনও শত্রু তাকে অপহরণ করেছে কিনা তাও আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করছে পুলিশ।
ড. মুবাশ্বার হাসান সিজার গত মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) বিকাল থেকে নিখোঁজ। এ বিষয়ে খিলগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। জিডি নম্বর ৪৭১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন সিজার। একসময় সাংবাদিকতাও করেছেন। পরে যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স ও অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করেন তিনি।
খিলগাঁও থানার ওসি মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তিনি অবস্থান করছিলেন। সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় তিনি আগারগাঁও এলাকায় অবস্থান করছিলেন। তবে এরপর ফোনটি বন্ধ থাকায় সিজারের ব্যাপারে জানা যাচ্ছে না। তবে তার নিখোঁজের বিষয়টির পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। তদন্তও সেভাবে চলছে।’
কথা হলে মুবাশ্বার হাসান সিজারের চাচা মঞ্জুর হোসেন জানান, ‘২৫ অক্টোবর একজন নিজেকে ছাত্র পরিচয় দিয়ে বনশ্রীর বাসায় সিজারকে খুঁজতে আসে। সিজার তখন ছিল না। পরে সিজার বাসায় ফিরলে জানানো হয়। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। নিরাপত্তার জন্য বাসায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে এবং সতর্কও হয়। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পুলিশ নিয়ে গেছে।’
সিজারের নিখোঁজের তদন্তে পুলিশ, র্যা বের সঙ্গে সরকারের গোয়েন্দারাও কাজ করছে। তথ্য-প্রযুক্তি এবং নিজস্ব সোর্স দিয়ে তারা সিজারের অবস্থান জানার চেষ্টা করছে বলে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আরো বলেন, নিখোঁজ হওয়ার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। তবে বিভিন্ন সময় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রের জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তারাও রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
র্যা ব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ইমরানুল হাসান বলেন, নিখোঁজ মুবাশ্বারের বাবা বিষয়টি আমাদের জানিয়েছেন। তার অবস্থান শনাক্ত করে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
বুধবার (৮ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘কোনো নিখোঁজই কাম্য নয়, যদি কেউ নিখোঁজ হয়ে থাকেন, তাকে খুঁজে বের করা হবে’।

 

http://www.dailysangram.com/post/306999