১০ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০২

ওসিসিতে কান্না, ৯ মাসে ২৪৮৮ নারী-শিশু নির্যাতনের শিকার

পাঁচ বছরের অবুঝ শিশু। রাজধানীতে পিতা-মাতার সঙ্গে থাকে। গত ১লা আগস্ট পিতার সঙ্গে বেড়াতে যায় ফুফার বাসায়। সেখানে সমবয়সীদের সঙ্গে খেলা করছিল শিশুটি। এক পর্যায়ে ফুফার বাসার ভাড়াটিয়া ২০ বছরের যুবক রিমন তাকে চকলেট দেয়ার নাম করে নিজের কক্ষে ডেকে নেয়। সেখানে জোর করে শিশুটিকে ধর্ষণ করে।

পরে শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) মেডিকেল পরীক্ষাসহ তিনদিন ধরে তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। এই সময়ে শিশুটিকে মনোসামাজিক কাউন্সিলিং করা হয়। আরেক ঘটনা- পিতা-মাতা হারা বাক ও শারীরিক এক প্রতিবন্ধী। ভাই-বোনও নেই তার। অন্যের বাড়িতে কাজ করে। গত ২৫শে জুলাই স্থানীয় একটি এনজিও তাকে ৪টি ছাগল দেয়। গত ২৮শে জুলাই ওই ছাগল চরাতে গেলে প্রতিবেশী মন্টু শেখ তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। একইসঙ্গে এ ঘটনা কাউকে জানালে জানে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়। পরে স্থানীয়রা ধর্ষণের শিকার এই প্রতিবন্ধী নারীকে উদ্ধার করে খুলনার পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সেখান থেকে তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে স্থানান্তর করা হয়। ১২ বছরের আরেক শিশু। ব্যবসায়ী পিতার পূর্বপরিচিত মাসুম (২০) নামে এক বখাটে তাকে গত দুই বছর ধরে বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করে আসছিল। এক পর্যায়ে কৌশল পাল্টায় মাসুম। অভিনয় করে ভালবাসার। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গত ২১শে আগস্ট কৌশলে একটি হোটেলে নিয়ে ধর্ষণ করে রাত ১১টার দিকে তাকে হোটেলের সামনে ফেলে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ওসিসিতে মেডিকেল পরীক্ষা করানো হয়। শুধু এ তিনটি ঘটনাই নয়। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটছে। প্রতিমাসেই পরিসংখ্যান বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে দেশের ৮টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ২৪৮৮ জন নারী ও শিশু। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ৯ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যৌন নির্যাতনের পাশাপাশি রয়েছে যৌতুকের জন্য নির্যাতন, স্বামী ও বখাটের ছোড়া এসিডে দগ্ধ। পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন মাসে নারী নির্যাতনের হার বেড়েছে ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ।
সরকারি এই সংস্থাটি দেশের ৮টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিষ্ঠিত ৮টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) এর কার্যক্রম পরিচালনা করে। এগুলো হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক), রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (রামেক), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক), বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (খুমেক), রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (রমেক) ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসি। এসব ওসিসিতে ভর্তিকৃত রোগীদের প্রয়োজনীয় কাউন্সিলিং, ডিএনএ প্রোফাইলিং ও স্ক্রিনিংসহ যাবতীয় সেবা তারা পরিচালনা করছে। সংস্থাটি প্রতি তিন মাস পরপর একটি নিউজলেটার প্রকাশ করে। তাতে ওসিসিতে ভর্তি হওয়া নির্যাতিতা, মামলা এবং রায়ের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৮টি ওসিসিতে নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ১৪৮৮ নারী-শিশু। প্রথম তিন মাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮৪১ জন। যাদের মধ্যে ২৫৫ জনই শিকার হয়েছেন যৌন নির্যাতনের। বাকিরা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতনের শিকার। গত বছরের শেষ তিন মাসে নির্যাতিতার সংখ্যা ছিল ৮২৭ জন। সে হিসেবে ওই তিন মাসে নির্যাতন বৃদ্ধি পায় ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। চলতি বছরের দ্বিতীয় তিন মাস অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৮৯১ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে যৌন নির্যাতনের শিকার ৩০৫ জন। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৫৬ জন নারী-শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে যাদের ৩৪৭ জন শিকার হয়েছে যৌন নির্যাতনের। এসব পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মার্চের তুলনায় এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত নারীর ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ আর দ্বিতীয় তিন মাসের তুলনায় শেষ তিন মাসে নির্যাতন বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২৯ শতাংশ। এরমধ্যে রামেক ওসিসিতে ৬ দশমিক ২, চমেক ওসিসিতে ২০ দশমিক ৬১, সিমেক ওসিসিতে ৩৮ এরং রমেক ওসিসিতে ৬১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ঢামেক ওসিসিতে শূন্য দশমিক ৩, খুমেক ওসিসিতে ৩৫ দশমিক ২৯ বরিশাল ওসিসিতে ৬ দশমিক ২৫ এবং ফরিদপুর ওসিসিতে ২১ দশমিক ৬২ শতাংশ নির্যাতিত রোগীর সংখ্যা কমেছে। তবে দিন দিন নারী নির্যাতনের সংখ্যা বাড়লেও এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলার রায় একেবারেই হতাশাজনক। গত ৯ মাসে ওসিসিতে চিকিৎসা নেয়া নির্যাতিদের পক্ষে মামলা হয়েছে ৬৩০টি। গত ৯ মাসে ২০৩টি ঘটনার রায় হয়েছে। এরমধ্যে ১৬টি মামলার আসামিকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। যেগুলোর বেশির ভাগই ৩ থেকে ১০ বছর আগের ঘটনা।

সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের পরিচালক ড. আবুল হোসেন বলেন, আগের চেয়ে বর্তমান মানুষের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন কমে এসেছে। ফলে মানুষের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে মানুষের ভেতরে পাশবিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিরও একটা কুপ্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে প্রভাবশালীদের দাপট, বিচারহীনতা, বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে বিচারে সাজা না হওয়া- এসব কারণে অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যায়। এতে অপরাধীদের মধ্যে ভীতি কাজ করে না। এসব কারণে দিনদিন এসব ঘটনা বাড়ছে।

 

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=91288