১০ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪৮

দরিদ্রদের তালিকা তৈরি নিয়ে তেলেসমাতি

টানাটানির সংসার দিনাজপুর সদরের তালপাড়া গ্রামের আনোয়ারা বেগমের। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে তাঁর মতো দরিদ্রদের খুঁজে বের করতে গত এপ্রিলে ১৭ জেলায় খানাশুমারির কাজ শুরু করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
৭২৯ কোটি টাকার কর্মসূচির আওতায় ছিল দিনাজপুর জেলাও। এখন দেখা যাচ্ছে, শুমারির লোকজন আনোয়ারাদের বাড়িতেই যায়নি। দুস্থদের তালিকায়ও ঠাঁই হয়নি আনোয়ারা বেগমের। তাই সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুফলের বাইরে পড়ে গেলেন উত্তরের জেলার এই দরিদ্র নারী। দক্ষিণের উপকূলীয় জেলা বরগুনা সদরের চরকলনী এলাকার রোকসানা আক্তারও শুমারির খবর শোনেননি। তাঁদের বাড়িতে বিবিএসের গণনাকারী যায়নি। শুমারি থেকে তাঁরও এই বাদ পড়ার অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতের সহায়তা কর্মসূচি থেকে বঞ্চিত হওয়া। তালিকা তৈরিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এভাবেই লাখ লাখ মানুষ প্রাপ্য অধিকারের আওতার বাইরে রয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঋণে ৩২৮ কোটি টাকার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ন্যাশনাল হাউসহোল্ড ডাটা বেইস (এনএইচডি) বা খানাশুমারি প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল ২০১৩ সালে।
কাজ শেষ না হওয়ায় সময় বাড়ানো হয়েছে দুই বছর। আর ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়াবে ৭২৯ কোটিতে। কাঙ্ক্ষিত প্রস্তুতির অভাবে আগামী অর্থবছর থেকে সরকার ধনী-দরিদ্রের তালিকা ধরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে অন্তর্ভুক্ত করার যে পরিকল্পনা ছিল, তাও হচ্ছে না।
দাতা সংস্থার অর্থে নেওয়া মোটা অঙ্কের প্রকল্পটির লেজেগোবরে দশা হওয়ার জন্য যাদের দায়ী করা হচ্ছে তাদের মধ্যে আছে ডেভেলপমেন্ট ডিজাইন কনসালট্যান্ট (ডিডিসি) ও ঠেংগামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস) নামের দুটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ডিভিসি ২০ কোটি টাকা নিয়েছিল শুমারি শুরুর কথা সাধারণ মানুষকে জানানোর অঙ্গীকারে। টিএমএসএস নিয়েছে ৪০ কোটি টাকা শুমারিকর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণের জন্য। খোদ বিবিএসের কর্মকর্তারাই বলছেন, ডিডিসি প্রচার-প্রচারণা এবং টিএমএসএস প্রশিক্ষণের নামে ফাঁকিবাজি করেছে।

বিবিএস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করে চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে শুমারির ফল প্রকাশ করা হবে। ফল দেওয়া দূরের কথা, শুমারির দুই ধাপই বাকি রয়েছে। ফলে মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়াতে হয়েছে প্রকল্প ব্যয়ও। গত ১৮ সেপ্টেম্বর সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ করে নেওয়া হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী নির্বাচনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ অনেক দিনের। এ কারণেই নিরপেক্ষ একটি উপাত্তভাণ্ডর তৈরির এ উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সরকারের উদ্দেশ্য ছিল, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যাতে সত্যিকারের দরিদ্র মানুষরা স্থান পায়, সে জন্য ধনী-দরিদ্রদের একটি তালিকা তৈরি করা। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার। মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাও রয়েছে। প্রতিবছর এ খাতের বাজেটের কলেবর বাড়ছে। দরিদ্র মানুষ যাতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারে, সে জন্য ২২টি মন্ত্রণালয়ের আওতায় সারা দেশে ১৪৫টি কর্মসূচি চালু রয়েছে। চলতি বছর এসব কর্মসূচিতে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ জন্যই ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে সত্যিকারের দুস্থ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

মাস ছয়েক আগে যে ১৭টি জেলায় খানা শুমারি করেছিল বিবিএস, তার সব জেলাতেই রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। প্রতিটি খানা থেকে তথ্য নেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটি করা হয়নি। বাদপড়া পরিবারগুলোর অভিযোগ, এ রকম শুমারির কথা তারা শুনেনি; তাদের কাছে কেউ যায়ওনি। দিনাজপুর সদরের তালপাড়া গ্রামের লোকজন বিবিএস প্রতিনিধিদের বলেছে, তথ্য নেওয়ার আগে যে ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালানোর কথা, তা করা হয়নি তালপাড়া গ্রামে।

কালের কণ্ঠ প্রতিনিধি যোগাযোগ করলে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান ডিডিসি পরিচালক এ কে এম নাসিরুদ্দিন এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বিবিএসের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ডিডিসি কাজটি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এ ধরনের কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রতিষ্ঠানটির ছিল না। তাই তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। ’ দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে খানা শুমারির সময় বিবিএস নিজস্ব উদ্যোগে প্রচার-প্রচারণা করবে বলে জানান তিনি।
মাঠপর্যায়ে খানা শুমারির কাজ কিভাবে করতে হবে আঞ্চলিক অফিসার, জুনিয়র পরিসংখ্যান কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় টিএমএসএসকে; যদিও সংস্থাটির সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে বিবিএস কর্মকর্তাদের। ঠাকুরগাঁও সদরের পরিসংখ্যান কর্মকর্তা শামসুল আলমের মতে, ‘এককথায় টিএমএসএসের প্রশিক্ষণ ছিল জগাখিচুড়ি। একটি শুমারি পরিচালনা করতে গিয়ে আঞ্চলিক অফিসারদের যে ধরনের প্রশিক্ষণ দিতে হয়, তা সংস্থাটির জানাই ছিল না। এটি পুরোটাই কারিগরি প্রশিক্ষণ। তারা বিষয়টি বুঝতেই পারেনি। ফলে এই টাকাও জলে গেছে। ’ তবে টিএমএসএসের উপনির্বাহী পরিচালক আবদুল কাদের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সারা দেশে আমাদের ৪৮টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিই। ’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিবিএসের খানা শুমারিতে তারা প্রশিক্ষণের কাজ পেয়েছেন বলে জানালেন ওই কর্মকর্তা।
২০১৩ সালে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, এখনো কেন অর্ধেক কাজ শেষ হয়নি—কারণ অনুসন্ধানে জানা গেল, প্রকল্পটি পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েছে নানা কারণে। মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের কাজে ‘ট্যাব’ ডিভাইস ব্যবহার করা হবে নাকি কাগজে কাজ সারা হবে—দুই সচিবের হাত ঘুরে সেই সিদ্ধান্তে আসতে এক বছর সময় অপচয় হয়েছে। এ ছাড়া শুমারির জন্য প্রশ্নপত্র মুদ্রণ, প্রচার, সুপারভাইজার ও গণনাকারীদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠান ঠিক করতে গিয়ে অনেক সময় লেগে যায়। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করতেও সময় অপচয় হয়েছে। এই চার বছরে প্রকল্প পরিচালক বদল হয়েছে তিনবার। এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন পিডি নিয়োগ করার কিছুদিন পরই তাঁকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হলো। ’
উদ্দিষ্ট উপকারভোগীরা যাতে শুমারির কথা জানতে পারে এবং তালিকার বাইরে না থেকে যায় সে জন্যই সারা দেশে প্রচার-প্রচারণা চালাতে মাইকিং, পোস্টারিংয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ডিডিসিকে। তবে বিবিএসের কর্মকর্তারা তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে দেখেছেন, সাধারণ মানুষ শুমারি সম্পর্কে জানেই না। অনেক জায়গায় মাইকিং করা হয়নি। পোস্টার লাগানো হয়নি। প্রচার-প্রচারণা চালাতে যে ২০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা কোথায় খরচ হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে খোদ বিবিএসের মধ্যেই।

কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা যায়, বিবিএস দরপত্র আহ্বান করার পর প্রাপ্ত টেন্ডারগুলোতে কারিগরি প্রস্তাবে চতুর্থ হয়েছিল ডিডিসি। কিন্তু আর্থিক প্রস্তাবে প্রথম হয়ে কাজটি পেয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি।
প্রথম দফায় এসব অনিয়ম আর অসংগতি নজর এড়ায়নি ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকেরও। সংস্থাটি অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকির কারণে জুলাইয়ে মাঠপর্যায়ে দ্বিতীয় দফায় তথ্য সংগ্রহ ও সেপ্টেম্বরে তৃতীয় পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি বিবিএস। কবে নাগাদ দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় শুমারির কাজ শুরু হবে তা কেউ বলতে পারেনি। অবশ্য আগামী বছর জানুয়ারিতে দ্বিতীয় দফায় শুমারির কাজ শুরু করা যাবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
অভিযোগ রয়েছে গণনাকারীদের যোগ্যতা নিয়েও। এইচএসসি পাস থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সেটি মানা হয়নি। ফলে মাঠপর্যায় থেকে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা যায়নি। যোগ্যতা ছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে গণনাকারী নিয়োগ দেওয়া হবে না বলে কালের কণ্ঠকে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আশ্বাস দিয়েছেন।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/11/10/563759