১০ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪৬

আবারও ‘নিখোঁজ’ আতঙ্ক

৩ দিনে রাজধানীতে খোঁজ নেই তিনজনের

রাজধানীর কয়েকটি এলাকা থেকে কয়েকদিনে সাংবাদিক, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক দলের নেতাসহ ছয়জন নতুন করে নিখোঁজের ঘটনায় জনমনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। নিখোঁজদের দ্রুত খুঁজে বের করে প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের দাবি জানিয়েছেন তারা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, নিখোঁজদের উদ্ধারে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

রাজধানীর সূত্রাপুর থানার লেবুপট্টি মার্কেটের সামনে থেকে ২৭ অক্টোবর নিখোঁজ হন বাংলাদেশ জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি মিঠুন চৌধুরী। মিঠুনের সন্ধানের দাবিতে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন তার স্ত্রী সুমনা চৌধুরী সীমা। তিনি বলেন, ১৪ দিন অতিবাহিত হলেও জানি না স্বামী কোথায় আছেন, কেমন আছেন? তাকে আটক করা হলে তা জানার অধিকার রয়েছে। এদেশের নাগরিক হিসেবে তার রাজনীতি বা দল করার অধিকার আছে। তিনি কোনো অপরাধ করে থাকলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার করা হোক।

সুমনা চৌধুরী আরও বলেন, ২৭ অক্টোবর রাত ১২টা ১০ মিনিটে লেবুপট্টি মার্কেটের সামনে থেকে তার স্বামী মিঠুন ও বাংলাদেশ জনতা পার্টির নেতা আশিক ঘোষকে একটি কালো গাড়িতে তুলে নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ বিষয়ে সূত্রাপুর থানায় জিডি করতে গেলে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, কাউন্টার টেরোরিজম তাদের আটক করেছে। জিডি নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, জানি না কি অপরাধে তাদের আটক করা হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন,নিখোঁজের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এসব ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। এগুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হওয়া দরকার। তিনি বলেন, সরকারি বাহিনীর কথা কেউ উল্লেখ করে থাকলে সেটি উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো ব্যাপার। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দেশের পুলিশে মিসিং পারসন স্কোয়াড থাকে। তারা শুধু নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধার ও ঘটনার তদন্ত করে থাকেন। এ ধরনের স্কোয়াড লন্ডন ও ওয়াশিংটনেও রয়েছে। সেখানে এসব ঘটনা এন্ট্রি হলে তদন্ত করে নিখোঁজদের উদ্ধার করা হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, পাঁচ বছরে রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে নিখোঁজ হন ৫১৯ জন। তাদের মধ্যে ৩২৯ জনের এখনও হদিস মেলেনি। আসকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১০ সালে ৪৭ জন, ২০১১ সালে ৫৯ জন, ২০১২ সালে ৫৬ জন, ২০১৩ সালে ৭২ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন, ২০১৫ সালে ৫৫ জন, ২০১৬ সালে ৯৭ জন ও চলতি বছরের সাত মাসে ৪৫ জন নিখোঁজ হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা যুগান্তরকে বলেন, যতটুকু জেনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিক জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লিখতেন। সেই কারণে তাদের কোনো গোষ্ঠী তুলে নিয়ে থাকতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়া রহমান যুগান্তরকে বলেন, সাংবাদিক ও শিক্ষক নিখোঁজের বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত নিখোঁজদের দ্রুত খুঁজে বের করা এবং নিখোঁজের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করা। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে মানুষ কথা বলার সুযোগ পাবে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ তুলে নেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিখোঁজের ঘটনা তদন্ত করে আসল রহস্য উদঘাটন করে জনমনের এসব শঙ্কা দূর করতে হবে।
সিজারের বাবা মোতাহার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, মঙ্গলবার বিকাল ৩টার দিকে সিজারের মোবাইল ফোনে কল করলে তিনি তা ধরেননি। তবে ঘণ্টাখানেক পর কল ব্যাক করে তিনি বলেন, জাতিসংঘের একটি বৈঠকে যাচ্ছেন। রাতে বাসায় ফিরবেন। কিন্তু রাত ৯টার দিকে আবার কল করা হলে ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। সেই থেকে তার নম্বরটি বন্ধ রয়েছে। ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিখোঁজের পর খুব বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি। তবে পেশাগত কারণে কেউ তাকে তুলে নিয়েছে কিনা সেটা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি বলেন, অনেকগুলো কারণে একজন ব্যক্তি নিখোঁজ হতে পারে। তার লেখালেখির বিষয়টি আমরা গুরুত্বসহ নিয়েছি। এক সপ্তাহে রাজধানীর খিলগাঁও থেকে দু’জন ও শাহজাহানপুর এলাকা থেকে একজন নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের মধ্যে শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও প্রকৌশলী রয়েছেন। মঙ্গলবার খিলগাঁও থেকে দুই ভাই আসাদুজ্জামান (৩৫) ও ফয়সাল রহমান (৩০) নিখোঁজ হন। তবে আসাদুজ্জামান ফিরে এসেছেন। আসাদুজ্জামানের বরাত দিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা জানান, অফিস যাওয়ার সময় দুই ভাইকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আসাদুজ্জামানকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু এখনও বাড়ি ফেরেননি তার ছোট ভাই ফয়সাল। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়।

এর আগে ২২ আগস্ট বনানী ফ্লাইওভারের নিচ থেকে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা ও এবিএন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ সাদাত আহমেদ। এ ঘটনায় তার স্ত্রী ক্যান্টনমেন্ট থানায় অপহরণের মামলা করলেও এখনও তার খোঁজ মেলেনি। পরিবারের দাবি, ঘটনার দিন সাদাত তার এক ব্যবসায়িক অংশীদারের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। ২৭ আগস্ট একই কায়দায় তুলে নেয়া হয় আরএমএম গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক অনিরুদ্ধ কুমার রায়কে। বেলারুশের অনারারি কনসাল হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাশিয়ান গ্যাস কোম্পানির লোকাল এজেন্ট হিসেবেও কাজ করতেন তিনি। শিল্পায়ন ও রফতানিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার কারণে টানা সাতবার কমার্শিয়াল ইম্পর্ট্যান্ট পারসন (সিআইপি) হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্রাব) এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কোনো নিখোঁজই কাম্য নয়। কেউ নিখোঁজ হলে তাকে খুঁজে বের করা হবে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/11/10/170389