১০ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪৫

বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তি

শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা

চলতি বছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করায় বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে। এবার শিক্ষার্থীদের চাপ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ টাকা কামানোর নতুন কৌশল নিয়েছে। ন্যূনতম পাস নম্বরপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দিতে তাদের কাছ থেকে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা বুকিং মানি রাখা হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত বেশি নম্বরপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের পাওয়া যায়নি এ অজুহাত দেখিয়ে নির্ধারিত সময়ের পর কলেজগুলো তাদের (কম নম্বরপ্রাপ্ত) ভর্তি করে নেবে। আসলে এর পেছনে রয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের নির্বাহী কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ৯৫ ভাগ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এ সুযোগ কাজে লাগাতে উঠেপড়ে লেগেছে। তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী সরকারি মেডিকেলে ভর্তির পর অবশিষ্ট সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তদের ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা। কিন্তু এবার বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগেই ন্যূনতম পাস নম্বরপ্রাপ্তদের ভর্তির সুযোগদানে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা বুকিং মানি রাখছে। নির্ধারিত সময়ের পর কলেজগুলো দেখাবে যে, অপেক্ষাকৃত বেশি নম্বরপ্রাপ্তরা ভর্তি হতে আসেনি। তাই কম নম্বরপ্রাপ্তদের ভর্তি করা হয়েছে। আর এর অন্তরালে থাকবে বিপুল টাকার লেনদেন।
এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক যুগান্তরকে জানান, মগবাজারে অবস্থিত একটি মেডিকেল কলেজে মেয়ের ভর্তির বিষয়ে আলাপ করতে গেলে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে ৩০ লাখ টাকা দাবি করেন। এমনকি উত্তরার একটি মেডিকেল কলেজও একই পরিমাণ অর্থ দাবি করে। নির্ধারিত টাকার চেয়ে বেশি চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে জানান, এ বছর ভর্তি হতে টাকা বেশি লাগবে।

জানা গেছে, ৫ নভেম্বর বেসরকারি মেডিকেলে এমবিবিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তিসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেখানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল প্রণীত নীতিমালার আলোকে ন্যূনতম ৪০ বা তদূর্ধ্ব নম্বরপ্রাপ্তদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ভর্তির ক্ষেত্রে এসব শিক্ষার্থী তাদের পছন্দের কলেজে আবেদন করতে পারবেন। বিজ্ঞপ্তিতে ১৫ নভেম্বর থেকে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, ১৬ নভেম্বর আবেদনপত্র বিতরণ এবং ২৬ নভেম্বর আবেদনপত্র জমা নেয়ার শেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করা শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কর্তৃপক্ষ ভেতরে ভেতরে ভর্তির প্রাথমিক কাজ শুরু করে দিয়েছে। বুকিং মানির মাধ্যমে ভর্তি করছে তারা। এ ক্ষেত্রে চলছে উভয়পক্ষের দরকষাকষি। কলেজগুলো ভাবছে, এ সুযোগ আগামীতে নাও আসতে পারে। অন্যদিকে অভিভাকরা ভাবছেন এবার ভর্তি করতে না পারলে সন্তানের এক বছর নষ্ট হবে। আবার আগামী বছর ভর্তিতে ৫ নম্বর কাটা যাবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের অর্থ সম্পাদক ইকরাম হোসেন বিজু যুগান্তরকে বলেন, আমরাও এমনটি শুনেছি। তিনি বলেন, গত বছর ও এ বছর মিলিয়ে ৯ মেডিকেল কলেজে ভর্তি স্থগিত করায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, নীতিমালা মানা হচ্ছে না এমন অভিযোগ এনে এসব মেডিকেল কলেজে ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। অথচ পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা মেনে চলে এমন কোনো মেডিকেল কলেজ হয়তো পাওয়া যাবে না। মেডিকেল শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য বন্ধে স্থগিত মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করার সুযোগ দিতে সরকারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। তিনি বলেন, স্থগিত কলেজগুলোকে নীতিমালা শর্ত পূরণে অন্তত এক বছরের সময় দিয়ে ভর্তির সুযোগ দিলে এ সমস্যার সমাধান হবে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আবদুর রশিদ যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ এখনও আসেনি। তবে এমনটি হয়ে থাকলে তা সুস্পষ্টভাবে সরকারি নীতিমালার অবমাননা- যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই এ ধরনের কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সেই কলেজের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, এ বছর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ৮২ হাজার ৭৮৮ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেন। এরমধ্যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ৮০ হাজার ৮১৩ এবং পাস করেন ৪১ হাজার ১৩২ জন। পাসের হার ৫০ দশমিক ৮৯ ভাগ। বর্তমানে ৩১টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা তিন হাজার ৩১৮ এবং বেসরকারি পর্যায়ে ৬৯টি মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা ছয় হাজার ২৫০টি। এদিকে, পরিচালনার শর্ত পূরণ না করায় চলতি বছর পাঁচটি বেসরকারি মেডিকেল ও একটি ডেন্টাল কলেজের ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এগুলো হল- ঢাকার নর্দার্ন ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, আইচি মেডিকেল কলেজ, সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ, কেয়ার মেডিকেল কলেজ ও কেরানীগঞ্জের আদ-দ্বীন বসুন্ধরা মেডিকেল কলেজ। গত শিক্ষা বর্ষে চারটির ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এগুলো হল- গাজীপুরের সিটি মেডিকেল কলেজ, খিলক্ষেতের আশিয়ান মেডিকেল কলেজ, রংপুরের নর্দার্ন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ও আশুলিয়ার নাইটিংগেল মেডিকেল কলেজ। সংশ্লিষ্টরা জানান, ৯টি মেডিকেল কলেজে আসন সংখ্যা ৬ শতাধিক। এই বিপুল আসনে ভর্তি স্থগিত থাকায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে কাজে লাগাতে সরকার নির্ধারিত ভর্তি ফি ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকার স্থলে অতিরিক্ত ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা বেশি চাওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে ৬০০ আসনের বিপরীতে গড়ে ১০ লাখ টাকা অতিরিক্ত নেয়া হলে ৬০ কোটি টাকা অতিরিক্ত পাবে মেডিকেল কলেজগুলো। আর বেসরকারি পর্যায়ে ৬৯টি মেডিকেল কলেজের ৬ হাজার ২৫০টি আসনের বিপরীতেই পাঁচ লাখ টাকা করে বেশি আদায় করে তাহলে অতিরিক্ত আদায়ের পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/11/10/170383