৯ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:১৭

নিজগৃহে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নারাজ বর্মী প্রশাসন ॥ ঘনীভূত হচ্ছে সংকট

আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অসহনীয় নির্যাতনের মুখে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসা বাংলাদেশে আশ্রিতদের নিজ ভূমিতে বসবাস করতে দিতে নারাজ বর্মী প্রশাসন। তাদেরকে সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ক্যাম্পে (আশ্রয় কেন্দ্রে) রাখার শর্তে, এমন বক্তব্য মিয়ানমারের। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রিতদের রোহিঙ্গা নেতাদের দাবি তারা স্বদেশে গিয়ে কেন ক্যাম্পে থাকবে? তাদেরতো বাপ দাদার ভিটেমাটি রয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, উগ্রপন্থী সমর্থিত বর্মী সরকার নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করে সময়ক্ষেপণের চেষ্টা চালাচ্ছে। বৈশ্বিক চাপের মুখে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় ভাব দেখালেও বার্মা ফের উগ্রপন্থীদের ইন্ধনে নতুন পরিকল্পনা আঁটে রোহিঙ্গাদের কোণ্ঠাসা করার জন্য। যাতে মুসলমানরা তাদের আধিপত্য বহাল করতে না পারে কোনভাবেই। দমিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে সেখানকার সবচেয়ে স্বাধীনচেতা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচারও চালানো হচ্ছে। যারা ছিল নিজভূমিতে অর্থসম্পদ ও চাষবাসের দিক দিয়ে অনেকবেশি স্বনির্ভর। যার ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংকটের মুখে পড়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রত্যাবাসনে আলোর মুখ দেখার পরিবর্তে অন্ধকারই ঘনীভূত হচ্ছে ক্রমশ।
সূত্রে প্রকাশ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ-বার্মা আলোচনা এখনো চলমান রয়েছে তবে এখনো স্পষ্ট কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি কোন দেশ। গতমাসে বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্মা সফরে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ১০দফা সম্বলিত এক প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। যার মধ্যে ছিল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হতে হবে নিজ গৃহে, কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন, প্রত্যাবাসন চুক্তিতে জাতিসংঘকে যুক্ত রাখা।
বার্মা সরকার এই প্রস্তাবের কোন একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশও মেনে নেয়নি বরং বার্মা সরকার নতুন করে প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশকে। যার মধ্যে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সব প্রস্তাবকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-বার্মা যে চুক্তি করেছিল এইবারও সেই চুক্তি অনুসারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে চায় বার্মা। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে তাদের নিজ গৃহে প্রত্যাবাসন করা হবে না, তাদের রাখা হবে শরণার্থী ক্যাম্পে এবং চুক্তিতে জাতিসংঘকে রাখতে রাজি নয় বার্মা। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে বার্মা কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ইচ্ছুক নয়।

এছাড়া আন্তর্জাতিক মহলের এ ব্যাপারে শক্ত কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে তারা। আরাকান রাজ্যে সেনাবাহিনীর সহিংসতার বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতভাবে একটি প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট গৃহীত হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তেনিও গুতেরেস এ বিষয়ে অসংখ্যবার তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। বার্মা সরকার এতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতাধর রাষ্ট্র এবং সংগঠনের উদ্বেগ সত্ত্বেও বার্মা এখনো জবাব দিচ্ছে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। বৈশ্বিক চাপে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা বললেও এখনো তারা বার্মায় থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক এনভিসি ধরিয়ে দিচ্ছে। যাতে করে তারা (রোহিঙ্গারা) কোন না কোনভাবে বিপর্যস্ত হয়। রোহিঙ্গারাও কোন উপায় না পেয়ে এনভিসি নিতে বাধ্য হচ্ছে এবং এনভিসি না নিলে তাদেরকে বলা হচ্ছে “হয় এনভিসি নাও, অন্যথা বাংলাদেশে যাও”। এসব কারণে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যেও উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে।

ফলে বার্মা সরকার কি আদৌ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চুক্তি করবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রত্যাবাসন হলেও রোহিঙ্গারা সেখানে শঙ্কাহীনভাবে বাস করতে পারবে কিনা; তা নিয়ে সংশয় সন্দিহানে পড়েছে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা।
জাতিসংঘের বিবৃতি বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার পথ রুদ্ধ করবে-মিয়ানমার : রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার পথ রুদ্ধ করবে বলে দাবি করেছে মিয়ানমার।

স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার মিয়ানমারের কার্যত নেতা অং সান সু চি’র কার্যালয় থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে এই দাবি করা হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত ক্ষমতা চর্চা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে রাজ্যটিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতনের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এই বিবৃতির জবাবে সু চির কার্যালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ যে সঙ্কট পার করছে, তা কেবল দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মধ্য দিয়ে নিরসন করা সম্ভব। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে মিয়ানমার সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ১৬ থেকে ১৭ নবেম্বর তার মিয়ানমার থাকার কথা রয়েছে। এদিকে, মাহমুদ আলীর সম্ভাব্য মিয়ানমার সফরের একদিন আগে বাংলাদেশ সফরে আসবেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। তার সফরের অন্যতম এজেন্ডা রোহিঙ্গা সংকট। নিরাপত্তা পরিষদ যে বিবৃতি নিয়ে মিয়ানমারের একজন প্রতিনিধি দাবি করেন, এই প্রস্তাবে তাদের সমস্যার সমাধান হবে না বরং তাদের উপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করবে। তিনি বলেন, ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির সন্ত্রাসী হামলার কারণেই সমস্যার শুরু হয়। বিদেশী সেনারাও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সংকট মোকাবেলায় মানবিক পরিস্থিতির তৈরি হয়। সেটা সমাধানে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশে গিয়েছে। দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তিনি আরো বলেন, মিয়ানমার হয়তো প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে অনেক কিছু এড়িয়ে গেছে। কিন্তু রাখাইনের সমস্যা সমাধানে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে সমস্যার সমাধান করবে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সোমবার এক বিবৃতিতে মিয়ানমারকে সহিংসতা বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন তারা। বিবৃতিতে রাখাইনে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে যেন তারা মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে পারে। এছাড়া আনান কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্যও আহ্বান জানানো হয়। গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতার পর রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা ও ধর্ষণ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেয় ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ বলে উল্লেখ করেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও অন্যান্য মানবিক সহায়তা দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে নিরাপত্তা পরিষদ। নবেম্বরের জন্য পরিষদের প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিনো কার্ডি এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ ও অন্যান্য এনজিওকে সাথে নিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশকে উৎসাহিত করেন। তারা জানায়, মিয়ানমার ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ যেন রোহিঙ্গাদের পাশে থাকে। ২৪ অক্টোবর রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়ে জাতিসংঘ মায়ামনমারকে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানায়।দুই দেশের যৌথ কমিশন গঠনের প্রয়াসকেও স্বাগত জানায় নিরাপত্তা পরিষদ। তারা দুই দেশকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারকে আমন্ত্রণ জানানো-সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে যুক্ত করার আহ্বান জানান।বাংলাদেশও এই প্রশংসার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সরকারি এক মুখপাত্র জানান, এই বিবৃতি খ্বুই সময়োপযোগী এবং এর মাধ্যমে সংকট সমাধান সহজ হবে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।তিনি বলেন, প্রকৃত ঘটনা অস্বীকার করায় মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করার প্রক্রিয়াটি জটিল হয়ে উঠেছে। রাখাইনের সন্ত্রাস ‘কাল্পনিক’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আশা করেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করছেন তাদের সহায়তা করবেন এবং বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ দেবেন। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।জাতিসংঘে ব্রিটিশ উপ-রাষ্ট্রদূত জোনাথন অ্যালেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ও মিয়ানমারের সমঝোতাকে আমরা স্বাগত জানাই। আশা করি তারা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিবে। এবং নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে তাদের থাকার পরিবেশ নিশ্চিত করবে।’নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটির জাতিসংঘ বিষয়ক পরিচালক অক্ষয় কুমার বলেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দেখিয়েছে যে তারা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সবাই একমত। তবে চীনের বিরোধীতা থাকলেও তারা প্রস্তাব পাশ হবে কিনা সেটা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। কারণ বিষয়গুলো চীনের জন্য অস্বস্তিকর।

 

http://www.dailysangram.com/post/306936