৮ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৩৮

এত বিনিয়োগ যাচ্ছে কোথায়

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ঋণ দেয়ার মতো নতুন কোনো উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। দৃশ্যমান কোনো বিনিয়োগ নেই। এর পরেও বেড়ে যাচ্ছে বিনিয়োগ। গত সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বেড়েছে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আর টাকার অঙ্কে তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ২৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতিই সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে এত বিনিয়োগ যাচ্ছে কোথায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘ দিন যাবৎ নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। ব্যাংকাররা পাচ্ছেন না নতুন বিনিয়োগকারী। এর পরেও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে বিপুল অঙ্কের। বাড়ছে বেসরকারি খাতের সার্বিক বিনিয়োগ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে বেসরকারি খাতের পুঞ্জীভূত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা, যেখানে গত সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে আট লাখ এক হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই মূলধনী যন্ত্রপাতি। আলোচ্য তিন মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হয়েছে (আমদানির জন্য ঋণপত্র নিষ্পত্তি) ১২৮ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, যা টাকার অঙ্কে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮২ টাকা হিসাবে)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টাকা পাচারের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হলো মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে সহজেই মুদ্রাপাচার করা যায়। গত পাঁচ-ছয় বছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কারা করেছে, যে পরিমাণ পণ্য আমদানির জন্য টাকা পাঠানো হয়েছিল ওই পরিমাণ পণ্য বা ওই মানের মূলধনী যন্ত্রপাতি আসছে কি না তা খতিয়ে দেখলেই টাকা পাচারের মূল হোতারা বেরিয়ে আসবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, টাকা পাচার যে হচ্ছে তার বড় প্রমাণ ওয়াশিংটন-ভিত্তিক অর্থপাচারবিরোধী সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে। গত এপ্রিলে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৪ সালেই পাচার হয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। দেশ থেকে প্রতি বছরই অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু এ অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একের পর এক সমঝোতাস্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সাথে। বলা হচ্ছে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে; কিন্তু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, টাকা পাচার বন্ধে ব্যাংকিং খাতে মানিলন্ডারিংসহ সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য সঠিকভাবে মনিটরিং হচ্ছে না। টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার এটাও একটা কারণ বলে মনে করছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাতে সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য গভীরভাবে মনিটরিং করা এবং ইতোমধ্যে যে অর্থ পাচার হয়েছে তা ফেরত আনার জন্য বিভিন্ন দেশের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর তাগিদ দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা।

দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, কার্যত দেশে নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন প্রকল্পে চলতি মূলধন সরবরাহ করছে। যারা নতুন বিনিয়োগ নিতে আসছে, তাদের ঋণ ফেরত দেয়ার অতীত রেকর্ড ভালো নয়। এ কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে; কিন্তু এর পরেও তিন মাসে ২৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের হিসাবকে তিনি অস্বাভাবিকই মনে করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বছর দুয়েক আগে মূলধনী যন্ত্রপাতির নামে মুদ্রাপাচার হচ্ছে এমন আশঙ্কা থেকে বড় অঙ্কের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির তথ্য চেয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সাতটি ব্যাংকের বড় অঙ্কের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে গরমিল পায়। এসব ব্যাংকের মধ্যে ছিল পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী, বেসিক ব্যাংক, একটি বিদেশী ও একটি স্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুদকের কাছে এ সাতটি ব্যাংকের তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ব্যাপক গরমিলের তথ্য দুদকের কাছে সরবরাহ করা হলেও এ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে কয়েক দফা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও দুদকের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল এর অগ্রগতি সম্পকে জানার জন্য; কিন্তু এরও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি দুদকের কাছ থেকে।

ওই সময় মূলধনী যন্ত্রপাতির মধ্যে প্রধান তিনটি খাতের আমদানির ওপর তদারকি করা হয়। এরমধ্যে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও বিদ্যুৎ খাত ছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিষয়টি প্রথমে হালকাভাবে নেয়া হলেও পরে প্রশ্ন ওঠায় শীর্ষ নীতিনির্ধারণীর নির্দেশে কারা এলসি খুলছে, আদৌও প্রয়োজন আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হয়েছিল। ওই তদন্তে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারের আভাস পাওয়া গিয়েছিল, যার তথ্য পরে দুদকে পাঠানো হয়েছিল। ওই কর্মকর্তা জানান, বর্তমান পরিবেশে কেউ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। অনেকেই নতুন বিনিয়োগের প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছেন। এ মুহূর্তে অধিক হারে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা তাৎপর্য বহন করছে।

 

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/266607