৮ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৩০

নীতিমালা ছাড়াই বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি অযৌক্তিক

দীর্ঘ সাত মাসেও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগের নীতিমালা চূড়ান্ত হয়নি। এ ব্যাপারে গঠিত কমিটির সুপারিশ জমা দেয়ার পর তিন মাস পার হয়েছে। কিন্তু ঝুলে আছে নীতিমালা তৈরির কাজ। অথচ নীতিমালা ছাড়াই সরকারের পছন্দের কিছু ব্যবসায়ীকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১০টি কোম্পানি প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ডলার বিদেশে নিয়ে গেছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৩৬০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নীতিমালা ছাড়া বিনিয়োগের অনুমোদন একেবারেই অযৌক্তিক, এক ধরনের বৈষম্য। এর ফলে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হবে। তাদের মতে, বিদেশে বিনিয়োগের বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে নীতিমালা চূড়ান্ত করে সবাইকে সমান সুযোগ দেয়া উচিত।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিতে হলে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকা উচিত। এটা না করে কেস টু কেস ভিত্তিতে কারও তদবিরে বিশেষ কোনো কোম্পানিকে অনুমোদন দেয়া হলে সেখানে স্বচ্ছতা থাকে না। তিনি বলেন, এ ধরনের অনুমোদনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত এবং দলীয় প্রভাব বিস্তার হয়। এতে দুর্নীতির সুযোগ থাকে। ফলে বিদেশে বিনিয়োগের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করে দেয়া উচিত। এ নীতিমালা বা শর্ত পূরণ করে যে আবেদন করবে, তাকে অনুমোদন দেয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এমনিতেই প্রতি বছর বিশাল অংকের টাকা দেশের বাইরে চলে যায়। এরপর নীতিমালা না করে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলে চোখের সামনে দিয়ে টাকা বাইরে চলে যাবে। এক্ষেত্রে কারও কিছু করার থাকবে না। তিনি বলেন, বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ার আগে অবশ্যই নীতিমালা জরুরি। না হয় যেসব শর্তের ভিত্তিতে দেয়া হল তার আইনি ভিত্তি থাকবে না। ফলে এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক হওয়া উচিত। ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, আমি যখন গভর্নর ছিলাম তখন এ ধরনের কিছু আবেদন আসে। আমি তা বিবেচনায় নিইনি। তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হয়, একজনকে দিলে অন্যরা অভিযোগ করবে। ফলে নীতিমালার বাইরে টাকা নেয়ার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, ভারতেও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আংশিকভাবে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট কনভার্ট করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই। তবে ব্যবসায়ী নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগের নীতিমালা করার জন্য এ বছরের এপ্রিলের শুরুতে একটি কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে নীতিমালা তৈরির প্রয়োজনীয় সুপারিশ তুলে ধরতে বলা হয়। কমিটি সাড়ে তিন মাস পর চলতি আগস্টের শেষে সুপারিশ জমা দেয়। কিন্তু ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে পছন্দের ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগ অনুমোদন দেয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব অজিত কুমার পাল যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগের নীতিমালার জন্য আমরা আগস্টের শেষের দিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করি। সুপারিশের মূল কথা হল বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগ করতে দেয়া উচিত। তিনি বলেন, সুপারিশে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু ক্রাইটেরিয়া ঠিক করা উচিত। এর মধ্যে ব্যবসায়ীদের রফতানির ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কর্মসংস্থান। কারণ বিদেশে বিনিয়োগ করলে বিদেশিরাও আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে। অজিত কুমার বলেন, এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে এ রকম কিছু প্রস্তাব এসেছিল। প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিদেশে বিনিয়োগের ভালো এবং খারাপ দিক মূল্যায়ন করে আমরা একটি সুপারিশ করেছি।

জানা গেছে, নীতিমালা না থাকলেও বিশেষ ব্যবস্থায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি আকিজ জুট মিলসকে মালয়েশিয়ায় ২ কোটি ডলার (১৬০ কোটি টাকা) বিনিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭টি গ্রুপ ২ কোটি ৪২ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। এর মধ্যে বস্ত্র খাতের দুলাল ব্রাদার্স আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় ৮০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে। ওষুধ খাতের প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কেনিয়ায় ৮০ লাখ ডলার, জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠান মবিল যমুনা মিয়ানমারে পাঁচ লাখ ১০ হাজার ডলার, ওষুধ খাতের আরেক প্রতিষ্ঠান এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালসকে প্যাটেন্টের (স্বত্ব) অর্থ পরিশোধের জন্য ৩০ লাখ ডলার, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস যুক্তরাজ্যে ১৩ হাজার ডলার, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং সিঙ্গাপুরে সাড়ে সাত হাজার ডলার বিনিয়োগ করছে। সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ারিং সাড়ে সাত হাজার ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। বিএসআরএম ৪৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। এছাড়া হা-মীম গ্রুপ হাইতিতে ১ কোটি ডলার নিতে চায়। নিটল-নিলয় গ্রুপ গাম্বিয়ায় ব্যাংক স্থাপনের জন্য ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে চায়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশে বিনিয়োগ করলে দুই ধরনের লাভ হবে। এক. বিদেশ থেকে মুনাফা আসবে। দুই. বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। বিদেশে বিনিয়োগের যুক্তি তুলে ধরে এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট আবদুল মাতলুব আহমাদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের চেয়ে ছোট অনেক দেশের ব্যবসায়ীরা বিদেশে বিনিয়োগ করছে। আমরা ৪-৫ বছর ধরে চেষ্টা করছি। বড় বড় শিল্প উদ্যোক্তা বিনিয়োগের সুযোগ চাচ্ছিল। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছিল রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হবে। এখন রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তাই বিদেশের বিনিয়োগের দ্বার উন্মোচন করা উচিত। মনে রাখতে হবে, ব্যবসায়ীরা বিদেশে ১ টাকা নিয়ে গেলে ৫ টাকা ফেরত আনবে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, প্রথমত বিবেচনা করতে হবে, বাংলাদেশের মতো দেশের বিদেশে বিনিয়োগের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে কিনা। এরপরও বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলে নীতিমালা তৈরি জরুরি। না হলে কিভাবে বিনিয়োগের বিষয়টি নজরদারি করা হবে, তা পরিষ্কার নয়। তার মতে, বিদেশের চেয়ে দেশে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান বাড়বে। ফলে সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
জানা গেছে, ১৪ মার্চ এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিদেশে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ নীতিমালা তৈরির বিষয়ে সভা হয়। সভায় বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম বিদেশে বিনিয়োগের অসুবিধার কথা তোলেন। এ সময় সরকারি একজন আমলা বলেন, বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগ করলে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত বিভিন্ন ‘নীতি সহায়তা’ পাবে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফার অংশ বাংলাদেশে পাঠাবে, যাতে দেশ লাভবান হবে। এরপর বিদেশে বিনিয়োগের জটিলতা দূর করতে বিডার নির্বাহী সদস্য-১ অজিত কুমার পালকে সমন্বয়ক করে চলতি বছরের এপ্রিলে ৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। যাতে অর্থ বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিডার একজন উপপরিচালককে প্রতিনিধি হিসেবে রাখা হয়।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/08/169846