৮ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:২৪

উচ্চতর ব্যয়ে নিকৃষ্টতম জীবন

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সম্ভবত এখন দেউলিয়া হয়ে গেছে। এখানে কোনো কিছুর ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বাজারে নেই। সমাজে নেই। ট্রাফিকে নেই। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে নেই। জনগণের কল্যাণে কোনো চিন্তা নেই। সরকার বলে যে কেউ আছে, তারও কোনো প্রমাণ কোথায়ও নেই। চালের কেজি ৭২ টাকা। লাউয়ের দাম ৮০ টাকা। পিঁয়াজের কেজি ৮৫ টাকা। ঢেঁড়শের কেজি ৮০ টাকা। শশা ৬০ টাকা কেজি। প্রতিদিনই যেন বাড়ছে গ্যাস বিদ্যুৎ পানির দাম। বাড়ছে হোল্ডিং ট্যাক্স। বাসের ভাড়া লাগামহীন। লক্কড় ঝক্কড় বাসেও লেখা সিটিং সার্ভিস। আসলে সেগুলো সব চিটিং সার্ভিস। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়কমন্ত্রী, এক সময় ফাটাকেষ্ট বলে যিনি কুখ্যাত হয়েছিলেন, সেই ওবায়দুল কাদের বেশ আগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, বাস মালিকরা খুবই শক্তিশালী। তাদের সঙ্গে পারা দুষ্কর। অতএব মরো সাধারণ নাগরিকরা। লাথি খাও দোকানদারের, লাথি খাও বাস মালিকদের। আর সরকার জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় ফুর্তি করে বেড়াক। বেড়াচ্ছেও তাই।
কয়েক দিন আগে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী আমাদের স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন যে, বন্যা হয়েছে, তাই দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। সরকারের কিছু করার নেই। তাই তো। বন্যা হলে সরকার কী করতে পারে? বন্যা তো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ করার ক্ষমতা কোনো দেশের কোনো সরকারেরই নেই। থাকলে আমেরিকায় বন্যা-টাইফুন কিছুই হতো না। হক কথা। কিন্তু নাগরিকরা বড় অকৃতজ্ঞ। সরকার যানজট নিরসনের জন্য মালিবাগ-মগবাজারে প্রায় নয় কিলোমিটারের তিন তলা এক ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে। এতে জনগণের প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সকল নগর বিশেষজ্ঞ এই ফ্লাইওভারের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু লোক দেখাতে কিছু একটা করার জন্য, একটা বিরাট স্থাপনা দেখানোর জন্য এই ফ্লাইওভার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এখন ফ্লাইওভার ঢাকাবাসীর গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। ফ্লাইওভার যখন ছিল না, তখন জ্যাম ঠেলে যে পথ এক ঘণ্টায় অতিক্রম করা যেত এখন তা পার হতে সময় লাগছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত। বিশেষ করে ফ্লাইওভার থেকে নামার রাস্তাগুলো চরম জ্যামে নাগরিকদের জীবন অসহনীয় করে তুলেছে। উপরন্তু আরও এক আজব কান্ড করেছে সরকার। ফ্লাইওভারের উপরে দিয়েছে ট্রাফিক সিগন্যাল। পৃথিবীর ফ্লাইওভারের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই প্রথম ট্রাফিক সিগন্যাল।

ফলে ফ্লাইওভারের ওপরেও তুমুল যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। পত্রপত্রিকাগুলো লিখছে, এ এক তিনতলার যানজট। যানজটের কারণে দিনে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ২৭০ কোটি ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
কিন্তু এখন উপায়। উপায় বলে কিছু আর আছে এমন মনে হয় না। এর একমাত্র সমাধান বোধ করি এই ফ্লাইওভার ভেঙে দিয়ে রাস্তা আবার আগের মতো করে তোলা। সেটা অসম্ভব ব্যাপার। আবার এই ফ্লাইওভার পরিত্যাক্ত ঘোষণা করার বিপদও অনেক। কারণ ফ্লাইওভার তৈরি করার ফলে নিচের রাস্তা সরু হয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। ফ্লাইওভার যদি পরিত্যাক্ত হয়, তবে সেই অর্ধেক রাস্তায় যানজট তীব্রতর হবে। আজব এক উন্মাদের দেশ! অথচ নগর পরিকল্পকরা এই ফ্লাইওভারে কখনোই সায় দেননি। নগর পরিকল্পনাবিদ ড. নজরুল ইসলাম আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন, নগরকে সচল করতে আমরা যেসব পরামর্শ দিয়েছিলাম, তার মধ্যে ফ্লাইওভারের ধারণাও ছিল না। তারপরেও সরকার কেন ১৩শ’ কোটি টাকা খরচ করে রাস্তার ওপর এমন জঞ্জাল তৈরি করল, বোঝা দুষ্কর। আর এসবের ফলেই এখন সারা পৃথিবীতে বসবাসের জন্য সবচাইতে নিকৃষ্ট শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। জানি না, সরকার এই নগরকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করার পরিকল্পনা করেছে কিনা।

শুধু ফ্লাইওভারই নয়, সমস্ত বিবেচনাতেই ঢাকা শহর এক নিকৃষ্ট নগরী। পত্রপত্রিকার রিপোর্টে দেখা যায়, ঢাকা শহরে প্রতিদিন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ঢুকছে প্রায় এক হাজার নাগরিক। কিন্তু তাদের থাকা খাওয়া, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন কোনো কিছুরই ব্যবস্থা নেই। ঢাকার খালগুলো ক্ষমতাসীন ষ-াপা-ারা দখল করে দিয়েছে। নগর প্রশাসকরা মাঝে মাঝে বলেন, এখনও ২৬টা খাল অবশিষ্ট আছে। সংবাদপত্রে সেসব খালের ক্ষীণধারা সচিত্র প্রতিবেন প্রকাশিতও হয়। কিন্তু খালগুলো থেকে আবর্জনা সরিয়ে ফেলার কোনো উদ্যোগ কোনো নগর প্রশাসন নেয়নি। আমরা বলেছিলাম, এগুলো খনন ও এখানকার আবর্জনা পরিষ্কারের পয়সা যদি নগর কর্তৃপক্ষের না থাকে, তবে তারা নাগরিকদের কাছে ভিক্ষা চাইতে পারে। ধারণা করি, নিজেদের সুস্বাস্থ্যের স্বার্থেই এবং জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পেতে আশপাশের নাগরিকরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন। শুধু আশপাশের নাগরিকরা কেন, এগুলো ইজারা দেয়া যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে। যেমন নগর কর্তৃপক্ষ আইল্যান্ডগুলো ইজারা দিয়েছে। ধরা যাক, একটি খালের যাবতীয় দায়িত্ব দেয়া হলো ধনাঢ্য বেক্সিমকো গ্রুপকে। তারা আবর্জনা পরিষ্কার করবে। খাল খনন করবে। দু’পাড় বাঁধিয়ে দিয়ে তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে। আর খালের নাম দেয়া হবে বেক্সিমকো খাল। নগর কর্মকর্তাদের সেদিকে কোনো খেয়াল আছে কিনা মনে হয় না। নগরীর হাল দেখলে বোঝা যায়, তারা কেবলই লুণ্ঠনের কাজে ব্যস্ত আছে। জনকল্যাণ তফাতে থাক।

ঢাকা শহরে প্রতিদিন রাস্তায় যোগ হচ্ছে তিন শতাধিক যানবাহন। শব্দ দূষণ সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এখানে যানবাহনগুলো সারাদিন যেভাবে হর্ন বাজায় পৃথিবীর কোনো বর্বরতম দেশেও সেরকমটি হয় বলে মনে হয় না। বাতাসে সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়েছে পাঁচ গুণ। ফলে হাঁপানিসহ নানা রোগ নাগরিকদের উপর ভর করেছে। এতে বেড়ে গেছে স্বাস্থ্যখাতে খরচ। অনেক অসুখ। অনেক খরচ। আবার স্বাস্থ্যখাতে এসব খরচ নিয়ন্ত্রণহীন। অসাধু চিকিৎসকরা সামান্য কফ-কাশিতেও ১০/২০টা টেস্ট দেন, যার একটিও হয়তো প্রয়োজনীয় নয়। আবার এসব টেস্ট এমন জায়গায় করাতে বলেন, যাদের আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি নেই। ঐ শ্রেণীর ডাক্তার কমিশনখোর। দায়সারাভাবে তারা পরীক্ষা করেন কিংবা মনের আন্দাজে যা খুশি লিখে দেন। ব্যয়ও এক এক জায়গায় এক এক রকম। রক্তের একই পরীক্ষা কোনো ল্যাবে যদি হয় ৮০০ টাকা। তবে অপর ল্যাবে তা ১৫০০ টাকা। এরশাদের আমলে এসবে দর বেঁধে দেয়া হয়েছিল। ল্যাবগুলো তা মেনেছেও। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সেসব মানামানি এখন আর নেই। ফলে নাগরিকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। আর তার পরিণতিতে যা হবার তাই হচ্ছে। চিকিৎসার জন্য নাগরিকরা বিদেশে ছুটছে। সেবার মান ভাল। ডাক্তারদের আচার ব্যবহার ভাল। চিকিৎসা ব্যয় কম। ফলে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতিবছর বিদেশে চলে যাচ্ছে।

এছাড়া নিরাপত্তাহীনতার দিক থেকে ঢাকা নগরীর হযবরল অবস্থা। ছিনতাই, খুন, নারী নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেই। পুলিশ এমন একটা ভাব করে, যাতে মানুষের মনে ক্রোধেরই সঞ্চার হয়। আবার অসাধু কিছু পুলিশ নিজেরাই ছিনতাই করে। নিজেরাই মুক্তিপণ আদায় করে। ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে। জমি দখল করতে ভাড়ায় খাটে। ফলে গোটা পুলিশ বাহিনীরই নিন্দা হচ্ছে। বিপদে মানুষ পুলিশের কাছে যেতে এখন ভয় পায়। আবার কোন্ বিপদে পড়ে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক স্থানেই মানুষ এসব অসাধু পুলিশকে ঘেরাও করে গণপিটুনি দিচ্ছে। কিন্তু পুলিশের অপরাধের শাস্তি বড় নগণ্য। শাস্তি সম্পর্কে সাধারণত আমরা দু’টি কথা শুনিÑ একটি হলো অপরাধীকে ক্লোজড করা হয়েছে। অপরটি হলো, দুর্বৃত্ত পুলিশকে বদলি করা হয়েছে।

এইসব দিক বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্সের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান তালিকার শীর্ষে। একটি শহরের বাসযোগ্যতা পরিমাপের জন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ৫টি বিষয়ের উপর মোট ৪০টি সূচক ব্যবহার করেছে। তাতে তারা দেখতে পেয়েছে অপরাধের মাত্রা ও সংঘাতের ঝুঁকি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো, সংস্কৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম। নিউ ইয়র্কের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মারসার কনসাল্টিং গ্রুপের অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে বিশ্বের ২২৩টি শহরে বসবাসের দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান ২০৮ নম্বরে। একটি শহরের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অপরাধ, দূষণসহ বেশ কয়েকটি সূচক বিবেচনায় নিয়ে তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, নিকৃষ্ট শহরের মধ্যে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনভিত্তিক সংস্থা হেলথ ইফেক্ট ইন্সটিটিউট চলতি বছরের শুরুতে বিশ্বব্যাপী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষণের নগরী।

উপরন্তু এখানে জীবন যাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। চাল, ডাল, তরিতরকারিসহ নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ২০১৫ সালে ২১ লাখ সরকারি চাকুরের বেতন বাড়লেও বেতন বাড়েনি বেসরকারি খাতের কর্মচারিদের। ঢাকায় মানুষের খরচ বেড়েছে। আয় বাড়েনি। ফলে যাদের সঞ্চয় আছে, তারা তা ভাঙিয়ে খাচ্ছেন। ঢাকায় বা গ্রাম গ্রামান্তরে মানুষ ধার দেনার উপর নির্ভর করে জীবিকা চালাচ্ছেন। এসবের কারণে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় এখন কানাডার মন্ট্রিয়ালের চাইতে বেশি। আর বসবাসের মান বিশ্বের নিকৃষ্টতম। ঢাকায় আমরা দারুণ আছি!

 

 

 

http://www.dailysangram.com/post/306711