৭ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৫০

সরকারি মার্কেট দখলে বেসরকারি সাইনবোর্ড

সর্বস্ব হারানোর ভয়ে মায়াকাটারার সাধারণ দোকানিরা

রাজধানীর সদরঘাট এলাকায় হাজার কোটি টাকা মূল্যের সরকারি সম্পত্তি দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি প্রভাবশালী চক্র। ওই সম্পত্তিতে মায়াকাটারা মার্কেট নামে গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজের একটি পাইকারি মার্কেট রয়েছে। সেখানে দোকানের সংখ্যা প্রায় তিনশ'। চক্রের সদস্যরা দোকানিদের জানিয়েছে, মার্কেটের মূল মালিক সাফায়াত গং মার্কেটটি বিক্রি করে দিয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী শাজাহান সিরাজ জুয়েলসহ কয়েকজন সেটি কিনেছেন।

তারা এখন বহুতল শপিং কমপ্লেক্স তৈরি করবেন। নতুন মার্কেট তৈরি হলে দোকানিরা আকার অনুযায়ী তাদের দোকান বুঝে পাবেন। এরই মধ্যে মার্কেটের ওপরে বায়নাসূত্রে মালিকানার বিশাল সাইনবোর্ডও টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় দোকানিরা পড়েছেন মহাবিপাকে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এ মার্কেটটি আসলে কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সরকারি সম্পত্তি। সরকারি সম্পত্তিতেই টানানো হয়েছে দখলের সাইনবোর্ড। সাধারণ ব্যবসায়ীরা সেখানে চরম আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। এ নিয়ে কোনো কথা বলতে গেলে তাদের গুম-খুনেরও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

মায়াকাটারা মার্কেটের সাধারণ দোকানিরা জানান, ৬৬ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত ওই মার্কেটের মালিক হিসেবে তারা এতদিন অবাঙালি সুলতান-মঈনুদ্দিন গংকে জানতেন। তবে কোনোদিন তারা মূল মালিককে দেখেননি। মালিকের লোক হিসেবে দোকান মালিক সমিতি ভাড়া আদায় করত। ২০১৪ সালে একবার মার্কেটের মালিকানা দাবি করে বর্তমান দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ইউসুফ মৃধা দুলাল সাইনবোর্ড টানিয়েছিলেন। সেখানে লেখা ছিল, বায়নাসূত্রে এই জমির মালিক ইউসুফ মৃধা দুলাল, হাবিবুর রহমান ও আবদুল হক। কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকার জেলা প্রশাসক কার্যালয় পুলিশ নিয়ে সেই সাইনবোর্ড উচ্ছেদ করে সেখানে আরেকটি সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়। সেখানে বলা হয়, জমির মালিকানার বিষয়টি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। পরে এ বিষয়ে কোতোয়ালি ভূমি অফিস একটি প্রতিবেদন দেয়। সেখানে বলা হয়, ২৭, ২৭/১ চিত্তরঞ্জন এভিনিউ হোল্ডিংয়ে মায়াকাটারা মার্কেটে ২৮৬টি দোকান রয়েছে। ওই সম্পত্তি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নামে রেকর্ডভুক্ত। ইউসুফ মৃধা দুলাল গং অবৈধভাবে এই জমির মালিকানা দাবি করে দোকানিদের হয়রানি করছে। আদালতও জমিটি সরকারের বলে রায় দেন।

ইউসুফ মৃধা সমকালের কাছে দাবি করেন, সম্পত্তিটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। সুলতান-মঈনুদ্দিনের উত্তরসূরি সাফায়াত গংয়ের। ২০১১ সালে ভুল করে সেটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নামে রেকর্ড হয়ে যায়।

এদিকে ওই ঘটনার পর মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে দোকান মালিক সমিতির কিছু লোক আরেকটি সমিতি গঠন করে। একতা বহুমুখী সমবায় সমিতি নাম দিয়ে ১৪৭ দোকানির স্বাক্ষর নিয়ে মার্কেটটি লিজ নেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তারা আবেদন করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও লিজ দিয়ে দেয়। এ ঘটনায় সাধারণ দোকানিরা অভিযোগ করেন, মার্কেটের মূল সমিতির নাম মায়াকাটারা দোকান মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতি। তাদের বাদ দিয়ে অন্য মার্কেটের দোকানিদের নাম ঢুকিয়ে একতা বহুমুখী সমবায় সমিতির নামে লিজ দেওয়া হয়েছে, যা বিধিসম্মত নয়। আর মার্কেটে দোকান মালিক ১৪৭ নন, ২৮৬ জন। এই ২৮৬ দোকান মালিক পরে আরেকটি সমিতি গঠন করেন, যার নাম গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ দোকান মালিক সমবায় সমিতি। সমবায় অধিদপ্তর থেকে তারা রেজিস্ট্রেশনও নেন। তাদের দাবি, মার্কেট লিজ দিলে এখানকার সব দোকান মালিককেই দিতে হবে।

জানা যায়, সম্প্রতি একতা বহুমুখী সমবায় সমিতির নেতৃবৃন্দ ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান প্রসিমো ডেভেলপমেন্টসের মালিক শাজাহান সিরাজ জুয়েলের সঙ্গে ওই মার্কেটটি বিক্রির একটি বায়নানামা করেন। এর পরই শাজাহান সিরাজ ওই মার্কেটের ওপরে বিশাল সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন। সরেজমিন দেখা যায়, সেখানে লেখা রয়েছে- 'মায়াকাটারা মার্কেট কমপ্লেক্স/বায়না সূত্রে এই জমির মালিক শাজাহান সিরাজ জুয়েল।'

দোকানিরা জানান, মূলত শাজাহান সিরাজ জুয়েলের নাম থাকলেও এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সিটি করপোরেশনের পার্শ্ববর্তী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আরিফ হোসেন ছোটন, বর্তমান দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ইউসুফ মৃধা দুলাল, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমানসহ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি।

অভিযোগ রয়েছে, কাউন্সিলর ছোটনের বাহিনী মার্কেটে নিয়মিত মহড়া দেয়। মার্কেটের দোতলায় তাদের আড্ডা। ছোটন এই এলাকার কাউন্সিলর নন এবং মার্কেটে তার কোনো দোকানও নেই। তারপরও তিনি একতার সদস্য।

এ প্রসঙ্গে আরিফ হোসেন ছোটন সমকালকে বলেন, মায়াকাটারা মার্কেটের জমির কিছু অংশের মালিক সরকার হলেও বাকি অংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন। অংশটুকু চিহ্নিত না হওয়ায় এ নিয়ে ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। তিনি একতা বহুমুখী সমবায় সমিতির সঙ্গে আছেন উল্লেখ করে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে মার্কেটটি লিজ নেওয়া হয়েছে। লিজের চুক্তিমতোই সবকিছু হচ্ছে।

সরকারি সম্পত্তি লিজ নিয়ে অন্যজনের কাছে বিক্রির বায়নানামা করা যায় কি-না সে প্রসঙ্গে মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, এটি বিক্রি নয়, মার্কেটটির উন্নয়ন করা হচ্ছে। লিজের চুক্তি অনুযায়ী মার্কেটের উন্নয়ন করার সুযোগ আছে। বায়নানামা হয়েছে, সেটি বিক্রির নয়, মার্কেট উন্নয়নের চুক্তিপত্র।

গত শনিবার সরেজমিন মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, এক যুবক মাইকিং করে বলছে, রোববার মার্কেটের প্রতিটি দোকানের আয়তন পরিমাপ করে তালিকা করা হবে। এ সময় দোকান মালিকদের দোকানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে দোকান মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ জানান, এখানে ২০ বর্গফুটের দোকানও আছে। ১০০ বর্গফুটের দোকানও আছে। নতুন করে দোকান তৈরি করতে গেলে তো সবাইকে ১০০ বর্গফুটের দোকান দেওয়া সম্ভব হবে না। এ জন্য পরিমাপ করা হচ্ছে। যদি কারও দোকান ৩০ বর্গফুট থাকে, নতুন নকশায় দোকানের আয়তন ৬০ বর্গফুট হলে অতিরিক্ত ৩০ বর্গফুটের দাম তাকে পরিশোধ করতে হবে। এ জন্যই আগে থেকে পরিমাপ করে রাখা হচ্ছে। সাধারণ দোকানিদের অভিযোগ, তাদের অনেকের কাছ থেকে হুমকি দিয়ে কাগজপত্র নেওয়া হচ্ছে। বহিরাগত একতা সমিতির সঙ্গে যুক্ত হতে না চাইলেও তারা কাগজপত্র দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা জানান, একতা বহুমুখী সমবায় সমিতির বিরুদ্ধে যাতে কেউ না যায়, সে ব্যাপারে তাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।

ভবিষ্যতে দোকান বুঝে পাবেন কি-না তা নিয়েও দোকানিরা সংশয়ে রয়েছেন। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, একটি মার্কেট তৈরি করতে হলেও দু-তিন বছর সময় লাগবে। এ সময় তাদের ব্যবসা বন্ধ থাকলে পরিবার-পরিজন নিয়ে কীভাবে চলবেন।

এদিকে মার্কেটের মালিকানার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর থেকেই অনেক দোকানি ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, যারা ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, তারা একটা সমস্যা জিইয়ে রেখে ভাড়া দেওয়া বন্ধ রাখতে চাইছেন। এ জন্য কয়েক দিন আগে বিপুল নামের এক দোকান মালিক নিজে আত্মগোপনে গিয়ে রটিয়ে দেন, দোকান মালিক সমিতির নেতারা তাকে অপহরণ করেছে। অথচ ১২ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে উদ্ধার করে পুলিশ।

এ প্রসঙ্গে বিপুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বিপুলের ভাই মামুনও ভাইয়ের উদ্ধার-রহস্যের বিষয়ে কিছু বলতে চান না। তিনি সমকালকে বলেন, ওই পক্ষটি মার্কেটটি দখলের চেষ্টা করছে। মার্কেটে একেকটি দোকানের মাসিক ভাড়া ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা। দখল করতে পারলে পুরো ভাড়া তারা আদায় করতে পারবে। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিসি অফিসেও তারা টাকা ঢেলেছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব শুভাশীষ বসুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। ঢাকা জেলার সহকারী উপকমিশনার (রাজস্ব) মো. শহিদুজ্জামান সমকালকে জানান, তিনি সম্প্রতি এখানে যোগ দিয়েছেন। কাজেই মার্কেটের মালিকানা সম্পর্কে তিনি অবগত নন। তবে সদরঘাট এলাকায় কয়েকটি সরকারি মার্কেট রয়েছে বলে জানান তিনি।

http://samakal.com/capital/article/1711365