৭ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩৪

বিমানের আকাশ ছোট হয়ে আসছে

বন্ধ হয়ে গেছে ১৩টি রুট * নতুন এয়ারক্রাফট এনেও বন্ধসহ নতুন রুট চালু হচ্ছে না * কার্গো বন্ধের পর কমছে লন্ডন ফ্লাইট * আসন ফাঁকা রেখেই চলছে বিমানের সিডিউল ফ্লাইট

বিমানের আন্তর্জাতিক রুট ক্রমশ কমে আসছে। ফ্রাঙ্কফ্রুট এবং রোমের রুট বন্ধ হয়েছে। নিউইয়র্কসহ বন্ধ রুটগুলো চালু হয়নি। এ অবস্থায় এবার কমছে ঢাকা লন্ডন ফ্লাইটের উইন্টার সিডিউলের স্লট। এ প্রথম বারের মতো ২ মাসের স্লট দিয়েছে যুক্তরাজ্য সিভিল এভিয়েশন। লোকসানের অজুহাতে রুট কমেছে। এরপরও আসন ফাঁকা রেখেই চলছে বিমান। নিরাপত্তার অজুহাতে কমেছে কার্গো পরিবহন। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্সটির আয় বাড়ছে না। এক সময় বিমানের রুট ছিল ২৮টি। এখন রুট চালু আছে ১৫। অধিকাংশ রুটই চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট এনেও নতুন রুট চালু করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্সটির স্লোগান ছিল ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। এখন অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা কারণে ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে বিমানের আকাশ।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন যুগান্তরকে বলেন, তার আমলে কোনো নতুন রুট বন্ধ হয়নি। ফ্রাঙ্কফ্রুট আর রোম বন্ধের সিদ্ধান্ত আগের। তিনি বলেন, অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ থাকার পরও নতুন রুট চালু হয়নি এটা ঠিক। এ কারণে বিমানকে নতুন রুট চালু করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলেছি। রুট বন্ধের পাশাপাশি যাত্রীও কমে যাচ্ছে। প্রতিদিন সিট ফাঁকা যাচ্ছে। উত্তরে মেনন বলেন, এটা ঠিক না, বিমানের যাত্রী কমেনি।
বিমানের ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম ঢাকা-লন্ডন রুটে ২ মাসের স্লট দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করার পর থেকেই তারা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে স্লট কমিয়ে দেয়ার কথা বলে আসছিল। তিনি বলেন, এর আগে গত বছরের মার্চে বিমানের সরাসরি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল?

বিমান সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিমান যাত্রী পরিবহন করেছে ২০ লাখ ২০ হাজার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিমানবহরে যুক্ত হয়েছে ৪টি বোয়িং ৭৭৭। এতে যাত্রী বাড়ার কথা ছিল ছিল ২৩ শতাংশ বেশি। সে হিসাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যাত্রী বেড়ে হওয়ার কথা ছিল ২৬ লাখ ৮৪ হাজার। কিন্তু বিমানের হিসাব মতে এ অর্থবছরে (২০১৫-১৬) যাত্রী পরিবহন করেছে ২২ লাখ ১৮ হাজার (হজযাত্রী ছাড়া)। একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যাত্রী আরও কমেছে। এ বছর ২২ লাখ যাত্রী পরিবহন করে বিমান। শুধু যাত্রীই কমেনি কার্গো পণ্য পরিবহনও হ্রাস পেয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিমান কার্গো পণ্য পরিবহন করেছে ৪৩ হাজার ৯২৪ টন। অপরদিকে এয়ারক্রাফট বাড়লেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিমান কার্গো পরিবহন করেছে ৪০ হাজার ৯১১ টন। এতে দেখা গেছে এক বছরে পণ্য পরিবহন কমেছে তিন হাজার ১৩ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কার্গো পরিবহন আরও কমেছে। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে গত দেড় বছরেও চালু করা সম্ভব হয়নি ঢাকা-যুক্তরাজ্য সরাসরি কার্গো পরিবহন। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নও বিমানে সরাসরি কার্গো পণ্য পরিবহন বন্ধ রেখেছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিমান আয় করেছে ৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। কিন্তু উড়োজাহাজ বাড়লেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আয় বেড়েছে মাত্র ৯ কোটি টাকা। অথচ হিসাব অনুযায়ী এ সময় আরও ২৩ শতাংশ বাড়ার কথা ছিল।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদ সদস্য ওয়াহিদুল আলম যুগান্তরকে বলেন, বিমানবহরে এখন ৪টি অত্যাধুনিক বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ও ২টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ইআর উড়োজাহাজ রয়েছে। এছাড়া ২টি ৭৩৭ ও ২টি ড্যাস-৮ উড়োজাহাজ আছে। বর্তমানে বিমানের যে বহর তাতে যাত্রী সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই হারে যাত্রী বাড়ছে না। দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর যাত্রী বাড়লেও বিমানের কমছে। একইভাবে কার্গো পরিবহনও কমছে দিন দিন।
সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সরাসরি বিমানে কার্গো পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বিমানের ঢাকা-লন্ডন যাত্রীবাহী ফ্লাইটও। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্ট (ডিএফটি) বিমানকে তেমন ইঙ্গিতই দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ঢাকা থেকে লন্ডন ফ্লাইটের উইন্টার সিডিউলের স্লট ৪ মাস কমিয়ে দিয়েছে যুক্তরাজ্য সিভিল এভিয়েশন। এ প্রথমবারের মতো ২ মাসের স্লট দিয়েছে। এর আগে উইন্টার (শীত) ও সামার (গরম) সিডিউলের স্লট দিত ৬ মাসের জন্য। স্লট কমিয়ে দেয়ায় ঢাকা-লন্ডন রুটে দীর্ঘ মেয়াদের টিকিট বিক্রি বন্ধের আশঙ্কা রয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে যুক্তরাজ্য সিভিল এভিয়েশনের কাছে জরুরি সাক্ষাৎ চেয়েছে বিমান। যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষ ২৮ নভেম্বর বিমানকে সাক্ষাতের সময় দিয়েছে।

জানা গেছে, এক সময় বিমানের রুট ছিল ২৮টি। চালু ছিল ২৬টি। কমতে কমতে এখন চালু আছে আঞ্চলিকসহ ১৫টি রুট। অধিকাংশ রুটই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক, লন্ডন, ম্যানচেস্টার, ফ্রাঙ্কফুর্ট, আমস্টারডাম, রোম, প্যারিস, ব্রাসেলস, টরেন্টো, হংকং, দিল্লিসহ ২৬টি আন্তর্জাতিক রুটে নিয়মিত বিমানের ফ্লাইট চলাচল করত। কিন্তু লোকসানের কারণে নিউইয়র্ক, ম্যানচেস্টার, ফ্রাঙ্কফুর্ট, আমস্টারডাম, রোম, প্যারিস, ব্রাসেলস, টরেন্টো অফিস, নারিতা, নাগোয়া, ত্রিপলি, হংকং, দিল্লি, মুম্বাই রুট পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে গেছে। সর্বশেষ বন্ধ হয়েছে ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং রোম। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা মিলে শুধু ঢাকা-লন্ডন রুট চালু আছে। সেখানেও স্লট কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে গোয়াংজু রুট চালু করার জন্য স্লট নিলেও তার মেয়াদ চলে গেছে। রুট চালু করা যায়নি। হংকং, নারিতা, দিল্লি, কলম্বো এবং কুনমিংসহ ৬টি রুট চালু বিষয়ে গত পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু গত দুই বছরেও রুটগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার থাকার পরও ঢাকা-নিউইয়র্ক রুট চালু হয়নি। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিমানের আন্তর্জাতিক রুট বাড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে ৪টি অত্যাধুনিক ৭৭৭-৩০০ ইআর এবং দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ কেনা হয়েছে। এছাড়া একটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর এবং দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ দীর্ঘমেয়াদি লিজে আনা হয়েছে। আরও দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ লিজে আনা হচ্ছে। এরপরও নতুন কোনো রুট খোলা তো দূরের কথা, বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি রুটও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।

শুরু রুটই কমছে না, পাশাপাশি যাত্রীও কমছে আশঙ্কাজনক হারে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চারটি রুটে গত ৩ মাসে ৩১ হাজার সিট ফাঁকা রেখে ফ্লাইট চলেছে। অভিযোগ আছে, সংস্থাটির আন্তর্জাতিক স্টেশনের কান্ট্রি ও স্টেশন ম্যানেজার এবং মার্কেটিং বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইন্স কোম্পানির কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেয়ার কারণে রুটগুলোতে নিয়মিত সিট ফাঁকা ছিল।
এ প্রসঙ্গে বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিমানের আন্তর্জাতিক স্টেশনের অধিকাংশ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ভিসা জটিলতার কারণে কিছু স্টেশন কর্মকর্তাদের সরানো যাচ্ছে না। শিগগির তাদের সরিয়ে আনা হবে।
বিমান চারটি রুটের ভ্রমণ করা যাত্রীদের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- জুন, জুলাই ও আগস্টে ঢাকা-লন্ডন রুটে বিমানের মোট আসন ছিল ৩৬ হাজার ৪৫৬টি। এর মধ্যে টিকিট বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার ৩০৩টি। ওই ৩ মাসে এ রুটে ১১ হাজার ১৫০টি আসন ফাঁকা ছিল। অর্থাৎ ৩০ শতাংশ আসন ফাঁকা রেখেই এ রুটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটগুলো পরিচালনা করা হয়।
ঢাকা-সিঙ্গাপুর রুটে গত ৩ মাসে যে ফ্লাইটগুলো চলাচল করেছে তাতে মোট আসন ছিল ২৯ হাজার ১৬০টি। টিকিট বিক্রি হয়েছে ১৯ হাজার ১৩২। আসন ফাঁকা ছিল ১০ হাজার ২৮টি। এ রুটে ৩৪ শতাংশ আসনই খালি ছিল।

ঢাকা-দুবাই রুটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আসন ছিল ২৮ হাজার ৭৩৪। টিকিট বিক্রি হয়েছে ২২ হাজার ১৩৮টি। ৩ মাসে এ রুটে আসন ফাঁকা ছিল ছয় হাজার ৫৯৬টি। অর্থাৎ ২৩ শতাংশ আসন ফাঁকা রেখেই এ রুটে বিমান ফ্লাইটগুলো চলাচল করেছে।
একই ভাবে ঢাকা-দোহা রুটে এই সময়ে চলাচলরত ফ্লাইটগুলোতে মোট আসন সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৭৪১টি। টিকিট বিক্রি হয়েছে ২১ হাজার ২৩৮টি। এ রুটে আসন ফাঁকা ছিল দুই হাজার ৫০৩টি। অর্থাৎ ১০ শতাংশ আসনই ফাঁকা ছিল।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/07/169614