৭ নভেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩৩

খুলনার কয়রা ৬৩ চিংড়ি খামারে ছাত্রলীগ নেতাদের জবরদখল

খুলনার কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কমিটি আছে মাত্র একটি কলেজে। দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ উপজেলা ছাত্রলীগের কার্যক্রম। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জেলা ছাত্রলীগ নেতাদের খুশি করাই হচ্ছে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের মূল কাজ। গত ৯ বছরে ৬৩ টি চিংড়ির ঘের, দুটি বাড়ি ও দোকান দখল করেছে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। পর্যায়ক্রমে মামলা হয়েছে। পুলিশের কাছ থেকে তিন বছর আগে অস্ত্র ছিনতাই মামলাও রয়েছে এদের বিরুদ্ধে।

ক্ষতিগ্রস্তদের দায়ের করা মামলা, জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে দেয়া ভুক্তভোগীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমাতাসীন হয়ার পর কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তৎকালীন সময়ের সভাপতি এস এম বাহারুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ ভাগবাটোয়ারার জন্য দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে। শুরু হয় দখল, পাল্টা দখল ও চাঁদাবাজির মহোৎসব। সে সময় দখল করা উল্লেখযোগ্য চিংড়ির খামারগুলোর মধ্যে শাকবাড়িয়া খাল, হায়াতখালীর খাল, আটরা খাল, তের আউলিয়া খাল, রেন বাকের খাল, কাটাকাটা গ্রামের দেলশাদ আলমের ঘের, উত্তর বেদকাশীর দেওয়ান খালীর খাল, দক্ষিণ বেদকাশীর হামিদ মল্লিকের ঘের, জামাল মেম্বরের ঘের ও বাচ্চু সরদারের ঘের দখল করে নেয়। স্থানীয় বাজারগুলোতে অর্থের বিনিময়ে প্রতিপক্ষকে দোকান দখল করিয়ে দেয়া হয়। প্রতিবাদ করায় দেয়াড়া গ্রামের যুবদল নেতা কোহিনুর এবং দৈনিক ইত্তেফাকের স্থানীয় প্রতিনিধি হুমায়ুন কবির ও জন্মভূমির শেখ হারুন অর রশিদ লাঞ্ছিত হয়। কয়রা বাজারের আশরাফের দোকান ভাঙচুর, যুবদল নেতা সাঈদ বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা ও উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতিকে বাড়ি ছাড়া হতে হয়।
স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জানায়, ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উত্তর বেদকাশী কাছারী বাড়ি বৃক্ষ মেলায় পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ও গুলী ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মদিনাবাদ গ্রামের ফজর আলী সানার পুত্র এস এম বাহারুল ইসলাম, যুগ্ম-সম্পাদক আমিরুল ঢালীসহ ৩০ জনের নামে মামলা দায়ের হয়। এ মামলায় আজও চার্জশীট হয়নি।
খুলনা জেলা প্রশাসনে দেয়া ৪ নং কয়রা গ্রামের আনসার আলী গাজীর পুত্র আসাফুর রহমান খোকনের অভিযোগ, উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দক্ষিণ মটবাড়ি (সুতির অফিস) গ্রামের আতিয়ার রহমান গাজির পুত্র মো. আল আমিন ইসলাম, ইব্রাহিম সানা ও মোহাম্মদ সৌরভ একই এলাকার ২৪ বিঘা জমির চিংড়ির খামার দখল করে নিয়েছে। স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা তিনশ’ টাকার সাদা স্টাম্পে আসাফুর রহমানের নিকট থেকে জোর পূর্বক স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে বলে এ অভিযোগে প্রকাশ।

ক্ষতিগ্রস্ত তালেব সানা জানান, পবনা থেকে প্রতাপ স্মরণি পর্যন্ত একশ’ বিঘা আয়তনের খাল জবর দখল করেছে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। গত দু’বছর যাবত এই খালের মালিকদের কোন প্রকার হারি দেয়া হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকরা হচ্ছেন-মুনসুর সানা, নুরুল ইসলাম, মহানন্দ, পরিমল, খগেন, জয়দেব ও বিষ্ণুসানা। এছাড়া খান বস্ত্রালয় নামক একটি ভবন ভাড়া নিয়ে তার ভাড়া দীর্ঘদিন পরিশোধ করেননি উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন। স্থানীয়দের আরও অভিযোগ উপজেলা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ঘের, দখল, চাঁদা বাজি, ধান কাটা, বাড়ি দখল ইত্যাদি অভিযোগ রয়েছে। কালনা গ্রামের হুমায়ুন কবিরের ৩০ বিঘা জমির চিংড়ির খামার জবর দখল করে রাখা হয়েছে। সুতির অফিস বাজারের খোকন মালির দোকান দখল করে উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নিজস্ব কার্যালয় গড়ে তুলেছেন। উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি এস এম বাহারুল ইসলাম বাদী হয়ে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আল আমিন গাজীর বিরুদ্ধে দু’টি মামলা করেছে। এস এম বাহারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি নিয়ম নীতি মেনেই চিংড়ি ঘেরের মালিক হয়েছেন। চাঁদাবাজি, জবর দখল, বিচারের নামে হয়রানি ইত্যাদি কোন অভিযোগ তার বিরুদ্ধে নেই।
কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন ইসলাম জানান, তার বিরুদ্ধে চিংড়ি খামার দখল করা একটি মামলা আদালত খারিজ করে দিয়েছে। পবনা থেকে প্রতাপ স্মরণি পর্যন্ত খাল দখলের সাথে তিনি সম্পৃক্ত নন। জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করা আসাফুর রহমান খোকনকে তিনি চেনেন না। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মধ্যকার অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বের কারণে প্রতিপক্ষ মামলা দায়েরে উৎসাহিত করছে। অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা ও বানোয়াট।

কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনামুল হক এখানকার চিংড়ির খামার জবর দখলের অভিযোগের কথা স্বীকার করেন। শাসক দল ছাত্রলীগের মধ্যে দু’টি গ্রুপ চিংড়ির খামার দখলের জন্য ইন্ধন জোগায়। স্বল্প জমি ডিড করে নিয়ে পুরো খামারটাই দখলে নিয়ে নেয়। অনেক সময় বিরোধের ঘটনা ঘটলেও পুলিশের উপস্থিতিতে তা নিরসন হয়। পুলিশি তৎপরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দখল প্রক্রিয়া কমে গেছে। উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে চিংড়ি খামার মালিক আসাফুর রহমান খোকনের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ সুপার তদন্তের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ঘের দখলের কারণে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান গত ২২ মার্চ দল থেকে বহিস্কৃত হন। কেন্দ্র সতর্কবার্তা দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তাকে স্বপদে বহাল করা হয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/306630