৬ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:৫৬

পথের খাবারে নজর চাই

রাজধানীর বনানীর একটি নামি বেসরকারি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রিকিতা সম্প্রতি টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ছয় দিন ভর্তি ছিল হাসপাতালে। পরীক্ষায় ধরা পড়ে, সালমোনেলা নামের ব্যাকটেরিয়া থেকে টাইফয়েড হয়েছে তার।
রিকিতার মা মার্জিয়া রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্কুল থেকে বের হয়েই মেয়ের বায়না ছিল ঝালমুড়ি কিংবা ফুসকা খাওয়ার। ডাক্তার বলেছেন, ওই খাবারের মাধ্যমেই ওর শরীরে ঢুকেছে টাইফয়েডের জীবাণু। ’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী ফাহমী প্রায়ই প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ার সমস্যায় ভুগত। বিষয়টি মা জেনে তাকে নিয়ে যান একজন ইউরোলজিস্টের কাছে। পরীক্ষায় ধরা পড়ে, ই-কোলাই জীবাণু বাসা বেঁধেছে তার শরীরে।

ফাহমীর বাবা মনজুর আলম বলেন, ‘স্কুল থেকে বের হয়ে কখনো ফুসকা, কখনো ভেলপুরি, কখনো চাটনি কিংবা পেয়ারা বানানো খাওয়া ছিল মেয়ের রুটিন। ডাক্তার বলেছেন, ওই সব অনিরাপদ পথখাবারের কারণেই এ সমস্যা হয়েছে। এখন সব বন্ধ করে দিয়েছি। ’
কেবল দু-একটি নয়, ঢাকার প্রায় সব স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বা কাছাকাছি এ ধরনের অনিরাপদ পথখাবার বিক্রি হচ্ছে।
আর তা খেয়ে শিক্ষার্থীরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
গতকাল রবিবার রাজধানীর ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনে গিয়ে দেখা গেল, ফটকের দুই পাশে ঝালমুড়ি, ফুসকা, চটপটি, ভেলপুরি, পেয়ারা-আমরা-চাটনির দোকান। দুপুরে ছুটি হতেই ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে এসব দোকানে। সঙ্গে থাকা অভিভাবকদের অনেককেও এসব খাবার খেতে দেখা গেল।

অথচ আগের দিন শনিবার সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—ঢাকায় ৯০ শতাংশ পথখাবারই অনিরাপদ। এ তথ্য দিয়ে ওই স্কুলের সামনে খাবার খাওয়া অভিভাবক রোকসানা মরিয়মের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্ট্রিটফুড তো আমার খুবই প্রিয়। দেশের বাইরে গেলে বেশির ভাগ সময়ই আমি স্ট্রিটফুট দিয়েই খাবার সারি। কিন্তু এটা যে বিদেশের মতো অত মানসম্মত নয়, সেটা তো ঠিকই। ’
খানিক দূরে আরেক স্কুলের সামনে দেখা গেল ফুসকা বিক্রেতা আয়নাল হোসেন একটি বালতির ভেতরে একের পর এক ময়লা প্লেট ধুয়ে তুলছেন ক্রেতাকে ফুসকা দেওয়ার জন্য। পাল্টে গেছে পানির রং। বিক্রেতা কিংবা ক্রেতা কারোরই নজর নেই সেদিকে। জানতে চাইলে আয়নাল বলেন, ‘ধারে কাছে পানি নাই। বারবার বাল্টি (মূলত বালতির পানি) পাল্টাইলে তো ব্যবসা লাঠে উঠব। ’

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকায় দুই বছরের মধ্যে পথখাবারে জীবাণুর সংক্রমণ বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ—আইসিডিডিআরবির গবেষণায় পথখাবারে জীবাণুর হার দেখা গিয়েছিল ৫৫ শতাংশ। আর গত শনিবার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে তা উঠে গেছে প্রায় ৯০ শতাংশে। যেখানে বেশির ভাগই পাওয়া গেছে স্কুলের সামনের পথখাবারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পথের পাশে খাবার তৈরি প্রক্রিয়া, রান্না, সংরক্ষণ, সরবরাহ—এসব স্তরে খাবার দূষিত হয়। দূষণের কারণ বা জীবাণুযুক্ত হওয়ার একটি বড় কারণ অনিরাপদ পানির ব্যবহার। তা ছাড়া বিক্রেতার নোংরা হাতে, গামছায়, প্লেটে বা কাগজে জীবাণু থাকে। এ ছাড়া মাছি বা অন্যান্য কীটপতঙ্গের কারণেও দূষণ ঘটে। এ ছাড়া বারবার টাকা ধরার মাধ্যমেও জীবাণু ছড়ায়।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ’ কার্যক্রমের সিনিয়র ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০১৫ সালে আইসিডিডিআরবির সঙ্গে এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় ১০ হাজারেরও বেশি স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা ছিল। এখন নিশ্চয়ই ওই সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি পরিস্থিতিও আরো খারাপ হয়েছে। কিন্তু এটা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে বরং স্ট্রিট ফুডকে কিভাবে কতটা নিরাপদ করা যায়, সেদিকেই নজর দিতে হবে। ’

২০১৫ সালের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অনিরাপদ পথখাবারের কারণ হিসেবে দেখা গেছে ৮৮ শতাংশ বিক্রেতাই ঠিকমতো হাত না ধুয়েই বারবার খাবার পরিবেশন করে এবং একই নোংরা পানিতে বারবার প্লেট-চামচ ধুয়ে তাতেই খাবার দিচ্ছে। তখন আমরা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে একটি প্রকল্পের আওতায় মোট ৬০০ স্ট্রিট ফুড ভ্যান তৈরি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে ফলোআপ করে দেখা গেছে সেগুলো আমাদের প্রত্যাশিত হারে ব্যবহার হচ্ছে না। বিক্রেতারা অনেক ধরনের বাধার কথা আমাদের বলেছে। ’
জানতে চাইলে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহম্মেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ই-কোলাই থেকে মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি সংক্রমণ হয়। আর সালমোনেলা থেকে টাইফয়েড ছাড়াও শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা কিংবা ডায়রিয়া হতে পারে। আর ছত্রাক বা মোল্ড থেকেও একই ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান—আইইডিসিআরের পরামর্শক ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ই-কোলাই, সালমোনেলা কিংবা মোল্ড—তিনটিই ক্ষতিকর জীবাণু। তাই এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
গতকাল দুপুরের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, শুধু যে শিক্ষার্থী তা-ই নয়, কলা ভবনের পাশের সড়কে পেয়ারা বানানো খাচ্ছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী ও বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রভাষক ফারিহা আবেদীন এবং তাঁর স্বামী আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক আশিকুর রহমান। এই খাবার কি নিরাপদ—এ প্রশ্নে ফারিহা বলেন, ‘নিরাপদ যে নয়, সেটা তো জানি। অনেক দিন পর নিজের ক্যাম্পাসে ঘুরতে এসেছি। তাই অনেকটা আবেগতাড়িত হয়েই আগের মতোই এই পথের খাবার খাচ্ছি। ’ তাঁর স্বামীও প্রায় একই জবাব দেন।
তবে দুজনই বলেন, শুধু বিক্রেতাতের দোষ দিলেই হবে না, যারা ভোক্তা তাদের যেমন সচেতনতা দরকার, তেমনি রাষ্ট্রের অবস্থান থেকেও এসব পথখাবার বিক্রেতাদের আরো ভালো পরিবেশ কিংবা নিরাপদ পন্থায় এসব বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কারণ এটা বন্ধ করার কোনো উপায় নেই, এর সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ জড়িত। ভোক্তাও অনেক।

এ কথোপকথন শুনে পাশে ভেলপুরি বিক্রেতা সোহেল বলেন, ‘সবাই খালি সবক দেয়। কিন্তু কেউ তো আমাগোরে কোনো সহায্য করে না, ভালো একটা দোকানও বানাইয়া দেয় না। বরং অনেক সময় পুলিশেও নানা ঝামেলা করে। ’
সরকারের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক দূষণ ও জীবাণু সংক্রমণ বিষয়ে সমীক্ষা পরিচালনাকারী এবং ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী জানান, ঢাকার ৪৬টি থানা এলাকার বিভিন্ন স্কুলের সামনে ঝালমুড়ি, ৩০টি ফুচকা, ১৬টি ভেলপুরি ও ৪২টি আচারের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ভেলপুরি, ফুচকা ও ঝালমুড়িতে ৮৫-৯০ শতাংশে ই-কোলাইয়ের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ৭৫ শতাংশ ভেলপুরি, শতভাগ ফুচকায় ইস্টমোল্ড পাওয়া যায়।

অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, ‘পথখাবার বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রথমেই তাদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আমরা ফুড সেফটি কার্যক্রমের আওতায় পরীক্ষামূলকভাবে খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে পথখাবার বিক্রেতাদের নিবন্ধন করে দিয়েছি। স্থানীয় সিটি করপোরেশন এ কাজ বাস্তবায়ন করেছে। ঢাকায়ও এটা সম্ভব। ’
জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান বলেন, ‘সারা দেশে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের মাধ্যমে আমরা নজরদারি করার চেষ্টা করছি; কিন্তু নানা সংকট ও সমস্যা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরো কিছু পরিকল্পনা আছে। ’

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/11/06/562145