৬ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:৫২

বিআইবিএমের গবেষণাপত্র

ছোট ঋণে খেলাপি ২২ হাজার কোটি টাকা

সাত বছরে খেলাপি বেড়েছে ৮৫০ শতাংশ * বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারাই দায়ী * সরকারি ব্যাংকের অধিকাংশ কর্মকর্তা ঠিকমতো অফিস করেন না

শুধু বড় নয়, ছোট ঋণেও খেলাপি বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। সাত বছরের ব্যবধানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এসএমই) দেয়া ঋণে খেলাপি বেড়েছে ৮৫০ শতাংশ বা সাড়ে ৮ গুণ। ২০১০ সালে এসএমই খাতে খেলাপি ঋণ ছিল আড়াই হাজার কোটি টাকা। ২০১৬ সালে তা প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকায় এসে ঠেকেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
বিআইবিএম গবেষকরা এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। তাদের শঙ্কা, এসএমই ঋণের অপব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। অন্য খাতেও এ ঋণ যেতে পারে। তা না হলে খাতটিতে বড় ঋণের মতো লাফিয়ে খেলাপি ঋণ এতটা বাড়ত না। এজন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দায়ী করছেন তারা। গবেষকরা বলছেন, এসব কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে এসএমই খাতের মতো ভালো খাতও খেলাপি খাতে পরিণত হচ্ছে। সরকারি ব্যাংকের অধিকাংশ কর্মকর্তা ঠিকমতো অফিসে আসেন না। যারা আসেন তারাও কাজে ফাঁকি দেন।

ব্যাংক খাত নিয়ে দুটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন উপলক্ষে রোববার মিরপুরে বিআইবিএম মিলনায়তনে সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এতে এসব উদ্বেগের কথা জানান সংশ্লিষ্টরা। বিআইবিএমের চেয়ার প্রফেসর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।
সেমিনারে ‘ইমপ্যাক্ট অব সোস্যাল সেফটি নেট প্রোগ্রামস অন দ্য পারফরমেন্স অব স্টেট ওন ব্যাংকস’ শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের পরিচালক অধ্যাপক মহীউদ্দিন ছিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন গবেষক দল। ‘ইমপ্যাক্ট অব এসএমই ফাইন্যান্সিং অন ব্যাংকস প্রফিটেবিলিটি : এন অ্যানকয়্যারি অ্যাক্রোস ব্যাংকস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন সহযোগী অধ্যাপক মো. সোহাইল মুস্তাফার নেতৃত্বাধীন গবেষক দল।

‘ইমপ্যাক্ট অব এসএমই ফাইন্যান্সিং অন ব্যাংকস প্রফিটেবিলিটি’ গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে এসএমই খাতে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র দুই হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৬১ কোটি টাকায়। এর পরের বছর তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪২ কোটি টাকায়। ২০১৬ সালে আরও চার হাজার খেলাপি ঋণ যুক্ত হয়ে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। এসএমই খাতের অর্থ ছাড়ের প্রবৃদ্ধি ২০১৬ সালে ছিল ২১ শতাংশ। এ সময় মোট অর্থ ছাড় হয়েছে এক লাখ ৩৬ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা।
‘ইমপ্যাক্ট অব সোস্যাল সেফটি নেট প্রোগ্রামস’ গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যাংকগুলোর সমন্বয় জরুরি।
সেমিনারে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিনা পয়সায় কাজ করে। রাষ্ট্রের অনেক সেক্টরে তারা কমিশন না নিয়ে সেবা দিচ্ছে। কিন্তু তাদের আরও বদলাতে হবে। শুধু বিনামূল্যে কাজ করার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে না। তিনি বলেন, আমি সোনালী ব্যাংকে যখন ছিলাম তখন দেখা গেছে ছয় থেকে আট হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিসে আসতেন না। এদের অনেকেই সিবিএ নেতা ছিলেন। এ ছাড়া যারা অফিসে আসতেন তারাও কাজে ফাঁকি দিতেন। এ অবস্থা বদলাতে হবে। তা না হলে সরকারি ব্যাংকের পরিবেশ ঠিক হবে না।
এস কে সুর চৌধুরী বলেন, এসএমই খাতে অর্থায়ন ব্যাংকের মুনাফায় তেমন প্রভাব পড়ছে না। কিন্তু আজকের এসএমই আগামী দিনে বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এ বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে এসএমই খাতে অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। তিনি এ খাতে জামানতবিহীন ঋণ দেয়ার জন্য ফ্যাক্টরিংয়ের মতো নতুন সেবা চালু করার পরামর্শ দেন।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলাম এসএমই সেক্টর ও এসএমই অর্থায়নে সঠিক কর্মপন্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান চৌধুরী বলেন, এসএমই ঋণ কোন খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কারণ প্রতি বছর প্রায় অর্ধেক ঋণ ফেরত আসছে না। দক্ষিণ ও উত্তর বঙ্গে দেয়া ঋণের মান ভালো বলে মনে করেন তিনি।
আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান বলেন, এসএমই খাতে আইডিএলসির ঋণ তিন হাজার কোটি টাকা। এ খাতে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ শতাংশেরও কম। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাইন্ডসেট (মানসিকতা) ঠিক করতে হবে। বিশেষ করে পরিচালনা পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্টের। তা না হলে খেলাপি ঋণ কমবে না। গ্রাহক বাছাইয়ে ভুল করা যাবে না।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ। সেমিনারে বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমেদ, ইয়াছিন আলী, পরিচালক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জিসহ বিভিন্ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

https://www.jugantor.com/last-page/2017/11/06/169451