মংডু এলাকার শাববাজার সফরকালে শরণার্থী ক্যাম্পের নকশা দেখছেন অং সান সু চি
৬ নভেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:৫০

রাখাইনে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ৫ বছর ধরে অবরুদ্ধ

রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঁচ বছর ধরে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা অবরুদ্ধ করে রেখেছে মিয়ানমার সেনা, পুলিশ ও নাসাকা বাহিনী। অবরুদ্ধ এ ক্যাম্প থেকে কাউকে বের হতে দেয়া হয় না। খাদ্য, পানীয়, ওষুধ কেনা এবং জীবিকার জন্য কোনো কাজের সন্ধানেও তাদের বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। আন্তর্জাতিক কোনো সাহায্য সংস্থারও প্রবেশে কড়াকড়ি রয়েছে। আর মিয়ানমার সরকারও তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সাহায্য দেয় না। অনেক ক্যাম্প সাগরের এত কাছে যে, জোয়ারের সময় তলিয়ে যায়। জাতিসঙ্ঘের একজন কর্মকর্তা একবার এ ক্যাম্প সফর করে বলেছেন, তিনি জীবনে এত নিকৃষ্ট কোনো ক্যাম্প দেখেননি।

২০১২ সালে গোটা রাখাইনে রোহিঙ্গা বিরোধী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেনা, পুলিশ, নাসাকা বাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। হত্যা করা হয় শত শত রোহিঙ্গা মুসলমানকে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এ দাঙ্গা। ২০১২ সালের দাঙ্গার সময় দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। তাদের বিভিন্ন এলাকায় ৪৮টি ক্যাম্পে আটকে রাখে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। সেখান থেকে সরকার তাদের নিজ বাড়িঘরে আর ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। মিয়ানমার সরকার চেয়েছিল তাদের রাখাইনের অন্য কোনো স্থানে বসবাসের ব্যবস্থা করতে। সে ক্ষেত্রে শর্ত হলো তাদের স্বীকার করতে হবে তারা রাখাইনের বাসিন্দা নয়, বলতে হবে তারা বাঙালি। কিন্তু তাতে তারা রাজি না হওয়ায় সরকার তাদের মানবেতর অবস্থায় অবরুদ্ধ করে রাখে ক্যাম্পে। এমনকি অনেককে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। যারা নৌকায় উঠতে আপত্তি করেছে তাদের গুলি করে মেরেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়েল ল স্কুলের প্রতিবেদনে রাখাইনের ক্যাম্পে অবরুদ্ধ রোহিঙ্গাদেরএ করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। ২০১৫ সালে এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও এখনো তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএচসিআর-এর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে রাখাইনে এ ধরনের ৩৬টি অবরুদ্ধ ক্যাম্পে এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে বর্তমানে। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল এক লাখ ৪০ হাজার।

রাখাইনের রাজধানী সিটওয়েসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এসব ক্যাম্প। বেশির ভাগ ক্যাম্প সাগর উপকূলে, যেখানে প্রায়ই আঘাত হানে ঝড় ঝাঁপটা।
জাতিসঙ্ঘের একজন আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এ ক্যাম্প পরিদর্শন করে বলেন, আমি আমার জীবনে অনেক ক্যাম্প দেখেছি কিন্তু এ ধরনের খারাপ কোনো ক্যাম্প জীবনে দেখিনি। তিনি বলেন, কোনো মানুষকেই এত খারাপ অবস্থায় বসবাস করতে দেয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত গাদাগাদি করে থাকা এসব রোহিঙ্গার জন্য জীবন ধারণের মৌলিক উপাদানের তীব্র সঙ্কট রয়েছে। খাদ্য, পানীয়, ওষুধ ও জীবিকা উপার্জনের চরম সঙ্কট রয়েছে। অনেক ক্যাম্প সাগরের এত কাছে যে, সেখানে জোয়ারের পানি চলে আসে। অনেক ক্যাম্প বর্ষাকালে তলিয়ে যায়। খাদ্যসঙ্কট সব সময় লেগে আছে। সরকার তাদের রেশনিংয়ের দাবি বরাবর অস্বীকার করে আসছে। অনেক রোহিঙ্গা জানান রেশন তালিকায় নাম থাকলেও কোনো রেশন পান না তারা।
ড্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিল, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বিভিন্ন সংস্থাও আইডিপি ক্যাম্পের খাদ্য, পানীয়, ওষুধ চিকিৎসাসহ মৌলিক উপাদানের তীব্র অভাবের কথা জানিয়েছেন। সেভ দ্য চিলড্রেন জানায়, একদিন একটি ক্যাম্পে সরকার ৯০০ ব্যাগ চাল নিয়ে আসে যেখানে দরকার ছিল তিন হাজার ৯০০ ব্যাগ। যে ৯০০ ব্যাগ আনা হয় তার মধ্যে আবার ১২টি ব্যাগ খালি। কিছু রোহিঙ্গাদের আঠা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে দেখেছে তারা।
তারা চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেও বাইরে যেতে পারে না। সেনা ও রাখাইনের লোকজন তাদের মানবিক সাহায্যও দিতে দেয় না। ত্রাণকর্মীদের সেখানে প্রবেশেও খুবই বাধা-নিষেধ রয়েছে। এমনকি বিদেশী সংস্থা কর্তৃক তাদের অন্যত্র ঘরবাড়ি বানিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করা হলেও সেনা ও রাখাইনের বৌদ্ধরা তাতে বাধা দিয়েছে। রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, ক্যাম্পে কেউ গর্ভধারণ করলে তার ওষুধ ও চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা করা হয় রোহিঙ্গাদের বংশবৃদ্ধি ঠেকাতে। চিকিৎসার অভাবে অনেক মা সন্তান জন্মের সময় যেমন মারা যায় তেমনি মারা যায় নবজাতক। সন্তান জন্মের সময় ক্যাম্পের বাইরে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই বললেই চলে। আর সুযোগ পাওয়া গেলেও তার ব্যয় বহন করার সামর্থ্য তাদের থাকে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাড়িঘর ছেড়ে যেসব রোহিঙ্গা আইডিপি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে তাদেরও সেনারা বাধ্য করে নৌকাযোগে দেশ ছেড়ে যেথায় খুশি চলে যেতে। এভাবে ক্যাম্প ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, নাসাকা এবং দাঙ্গা পুলিশ তাদের আইডিপি ক্যাম্প থেকে ধরে এনে নাসাকা ক্যাম্পের কাছে একটি জেটিতে রাখে। নাসাকা বলে তোরা হলি ‘কালা’। তোরা এ দেশে থাকতে পারবি না। তোরা যেথায় খুশি চলে যা। এরপর তাদের নৌকায় তোলে। যারা আপত্তি জানায় তাদের গুলি করে মেরে ফেলে। এরপর বাকিদের নৌকায় তুলে নৌবাহিনী তাদের নৌকা টেনে থাইল্যান্ডের দিকে নিয়ে যায়।
একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেন, সরকারের লক্ষ্য হলো মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মুছে ফেলা। কিন্তু তারা আমাদের সবাইকে গুলি করে মারতে পারছে না। তাই তারা আমাদের মেরে ফেলার জন্য এখন খাদ্য ওষুধসহ জীবন ধারণের মৌলিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। এভাবেও না মরলে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করা হয় বা জোর করে দেশছাড়া করা হয়। আরেক রোহিঙ্গা অভিযোগ করেছেন, অবরুদ্ধ রেখে তিলে তিলে তাদের মেরে ফেলাই মিয়ানমারের লক্ষ্য।

ইয়েল ল স্কুলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মিয়ানমার সরকারের নীতিই রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়নকে আনুষ্ঠানিকতা দিয়েছে। ২০১২ সালের দাঙ্গায় রোহিঙ্গাদের যেসব ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে এবং অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে তাদেরকে তাদের বাড়িঘরে ফেরার ব্যবস্থা না করে তাদের ‘অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুহারা ব্যক্তি’ বা ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পারসন, আইডিপি পরিচয় নিয়ে ক্যাম্পে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এমনকি রাজধানী সিটওয়ে থেকে অনেক বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের উত্তর রাখাইনের শহরতলিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যারা এভাবে সরকারের কথামত তাদের এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় যেতে রাজি হয়নি তাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়নি এমনকি তাদের খাবার দিতেও অস্বীকার করে সরকার।
২০১৪ সালে ফাঁস হওয়া একটি সরকারি নথিতে দেখা যায় সরকার পরিকল্পনা করেছে বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িঘরে ফিরতে দেয়া হবে না। বরং তাদের রাখাইনের অন্য কোনো অজ্ঞাত স্থানে স্থানান্তর করা হবে। যেসব রোহিঙ্গা বাঙালি পরিচয় ধারণে রাজি হবে কেবল তাদেরই অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে। যারা রাজি হবে না তাদের কোনো দায় দায়িত্ব সরকার নেবে না এবং তাদের ক্যাম্পেই থাকতে হবে।
২০১২ সালের ১২ জুলাই প্রেসিডেন্ট থেইন সিয়েন জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইইএনএইচসিআরের প্রতি দাবি জানান সব রোহিঙ্গাকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অথবা তাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হলো তাদেরকে জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া এবং তারাই তাদের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করবে। কোনো দেশ যদি রোহিঙ্গাদের নিতে চায় সেখানেও তাদের পাঠানো যেতে পারে। তিনি বলেন, আমরা শুধু আমাদের জাতিগোষ্ঠীর লোকদের দেখভাল করব। আমরা বিদেশ থেকে অবৈধভাবে আসা রোহিঙ্গাদের এখানে গ্রহণ করব না কারণ তারা আমাদের জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নয়।

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের ঘটনায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ ঘরে ফিরতে দেয়নি মিয়ানমার সরকার। বরং তাদের ক্যাম্পে সেনা পুলিশ ও নাসাকা বাহিনী দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। মুসলমানরা যাতে তাদের এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে সে জন্য পুলিশ ও সেনা তাদের পাহারা দেয়। এভাবে ঘেরাও করে রাখা মুসলমানদের এলাকা এবং আইডিপি ক্যাম্পগুলোকে একজন সাংবাদিক আখ্যায়িত করেছেন প্রাচীনকালে শহরের ইহুদিদের বস্তি এলাকা ঘেটোর সাথে।
এতে বলা হয়েছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, দশকের পর দশক ধরে রোহিঙ্গারা প্রতিবেশী অনেক দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। নৌকাযোগে পালাতে গিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা ডুবে মারা গেছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী শিশু পুরুষ পাচারকারদীদের শিকারে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে যাওয়া নৌকাবোঝাই এসব রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন সময় ভিড়তে দেয়া হয়নি প্রতিবেশী অনেক দেশে। তাদের ঠেলে দেয়া হয়েছে সাগরের দিকে। এভাবে পরিবারের সবাই মিলে মারা গেছে অনেক রোহিঙ্গা। ২০০৮, ২০০৯ সালে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাড়ি জমায় নৌকাযোগে। ২০১০ সালে থাইল্যান্ডগামী রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকা সাগরে ফিরিয়ে দিলে মারা যায় অনেক রোহিঙ্গা।
১৯৯৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাধ্য করেছে তাদের ঘরবাড়ি জমিজমা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে। ১৯৯৫ সালে জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি নোটিশ জারি করেছে এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে এবং সাথে কোনো সহায় সম্পদ নিতে পারবে না তারা। ২০০৯ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জানান, গ্রামের রাখাইন নেতারা রোহিঙ্গাদের গ্রাম ছেড়ে যেতে বলে রোহিঙ্গা-রাখাইন বিরোধ মীমাংসার অংশ হিসেবে। এভাবে উত্তর রাখাইনে অব্যাহত থাকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন।
ইয়েল ল স্কুলের গবেষণা প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের প্রতি সেনা, পুলিশ, নাসাকা, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীসহ গোটা মিয়ানমারবাসীর তীব্র ঘৃণা এবং বিদ্বেষের চিত্র ও কারণ তুলে ধরা হযেছে। এমনকি সরকারি সংবাদপত্র রোহিঙ্গাদের জন্য অপমানসূচক ‘কালা’ উপাধি ব্যবহার করে। কালা মানে খারাপ বাঙালি।
রাখাইনদের নিয়ে ২০১০ সালে গঠিত রাখাইন ন্যাশনালিটিস ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা আরএনডিপি রোহিঙ্গা-বিরোধী ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এ দলটি নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় দিলেও মূলত স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের সাথে রয়েছে এর ঘনিষ্ঠ আঁতাত। ২০১২ সালে জারিকৃত এক বিবৃতিতে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়, বাঙালিরা রাখাইনের সব মানুষ এবং অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর জন্য হুমকি। বিবৃতিতে বাঙালিদের মিয়ানমার থেকে পুরোপুরিভাবে বের করে দেয়ার দাবি জানানো হয়।

রোহিঙ্গা মুসলিমবিরোধী ঘৃণা ছড়ানো অপর আন্দোলনের নাম ‘৯৬৯’ আন্দোলন, যা এখন মা বাথা বা জাতীয়তা ও ধর্ম রক্ষা কমিটি নামে পরিচিত। এর প্রধান অশিন ভিরাথুর মতে মুসলমানরা হলো সাপ এবং পাগলা কুত্তা। তার মতে আপনি যদি কোনো মুসলমানের দোকান থেকে কোনো পণ্য কিনেন তাহলে আপনার সেই টাকা শুধু ওই দোকানেও থেমে থাকবে না। সে টাকা তারা ব্যবহার করবে আপনাকে ও আপনার ধর্মকে ধ্বংসের কাজে। এ টাকা দিয়ে তারা একজন বৌদ্ধ বর্মি নারী বিয়ে করবে। এরপর শিগগিরই সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে অথবা জোর করে তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করানো হবে। এভাবে ধীরে ধীরে তারা বেড়ে যাবে এবং একপর্যায়ে গোটা মিয়ানমার দখল করে অশুভ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করবে। মা বাথা আন্দোলনের সাথে যুক্ত রয়েছে মিয়ানমারের সব বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।
২০১২ সালের ঘটনার সময় রাখাইনের সব বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, বৌদ্ধদের বিভিন্ন সংগঠন যেমন রাখাইন সংঘ, আরাকানি ইয়ুথ মঙ্ক, ম্রাউক উ মঙ্ক রোহিঙ্গাদের বর্জন ও একঘরে করার দাবিসংবলিত ১২ দফা দাবির পোস্টারিং করে। রোহিঙ্গাদের সাথে সব ধরনের কেনাবেচা, যানবাহনে তাদের বহন করা, কাজ না দেয়া এমনকি খাবারও না দেয়ার দাবি জানানো হয়। রোহিঙ্গাদের সহায়তাকারী সব এনজিওর রাখাইন ছেড়ে যাওয়ার দাবি জানায় তারা। পোস্টারে তারা রোহিঙ্গাদের কালা আখ্যায়িত করে হিংস্র হিসেবে তুলে ধরে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্মি সেনাদের ফাঁস হওয়া একটি প্রামাণ্য চিত্রে দেখা যায় সেনাবাহিনী পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করে দেখাচ্ছে বাঙালি মুসলমানরা বার্মার জন্য হুমকি। তারা বর্মিদের মধ্যে ইসলামের প্রসার ঘটাতে চাচ্ছে, তাদের জনসংখ্যা বাড়িয়ে চলছে এবং রাখাইন ছাড়াও মিয়ানমারের অন্যান্য শহরে তাদের উপস্থিতি বাড়াতে চেষ্টা করছে।
ফাঁস হওয়া আরেকটি সরকারি নথিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা গোপনে এ দেশে প্রবেশ করেছে। তারা সশস্ত্র, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে এবং তারা রাখাইন দখল করবে। তাদের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। রাখাইনরা জীবন দিয়ে হলেও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে।
রাখাইনের প্রাচীন রাজধানী ম্রাউকের একটি গ্রামে ২০১২ সালে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বৈঠক ডাকে সেনা ও দাঙ্গা পুলিশ। তারা প্রস্তাব দেয় রোহিঙ্গারা যে বাঙালি এবং রাখাইনের স্থানীয় নয় এটা মেনে নেয়ার জন্য। কিন্তু তারা এটা অস্বীকার করে। এর ২০ দিন পর তারা জ্বালিয়ে দেয় গ্রামটি। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পোড়ানোর সাথে অংশ নেয় স্থানীয় বৌদ্ধরা। জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় সেনা, পুলিশ, নাসাকা সবাই অংশ নিয়েছে। এক তারকা সেনা থেকে শুরু করে মেজর সবাই রোহিঙ্গাদের হত্যায় লিপ্ত হয়।
সিটওয়ে হাসপাতালের যেসব ডাক্তার আহত রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন তাদের মেরে ফেলার নির্দেশ দেয় পুলিশ। গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার পর নিহত রোহিঙ্গাদের লাশ ট্রাকে করে নিয়ে যায় সেনারা। লাশ একত্র করে তারা আগুনে পুড়িয়েও দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ রোহিঙ্গাদের এলাকা ছেড়ে যেতে সময় বেঁধে দিয়েছে কিন্তু রোহিঙ্গাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। রোহিঙ্গাসহ রাখাইনের অন্য মুসলমানরা নৌকাবোঝাই করে তাদের অবরুদ্ধ গ্রাম থেকে পালিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলো নৌকাবোঝাই এসব রোহিঙ্গাকে ভিড়তে দিলো না তাদের দেশে। বাংলাদেশও ফিরিয়ে দিলো নৌকাবোঝাই রোহিঙ্গা। এভাবে আবার রাখাইনের রাজধানী সিটওয়ের দিকে ফিরে আসা নৌকাবোঝাই তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ভিড়তে দিলো না মিয়ানমার সরকারও। তারা গুলি চালাল তাদের ওপর এবং অন্য দিকে টেনে নিয়ে গেল এসব নৌকা। পানি ও খাদ্যের অভাবে নৌকায় মারা গেল অনেক রোহিঙ্গা। অন্যরা কোথাও ভিড়তে না পেরে সাগরের বিভিন্ন পাহাড় দ্বীপে ও জঙ্গলে পালিয়ে আশ্রয় নিলো।
২০১২ সালের দাঙ্গার পর উত্তর রাখাইনের যেসব রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে যায়নি তাদের জীবনও আইডিপি ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মতোই অনেকটা। তাদের চলাচলের কোনো স্বাধীনতা নেই। নিজ গ্রামের বাইরেও তারা যেতে পারে না। ফলে তারাও খাদ্য, পানীয়, ওষুধসহ মৌলিক বিষয়ে সঙ্কট মোকাবেলা করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা ক্যাম্পের চেয়েও খারাপ।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/265980