৫ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১১:০৩

চাল পেঁয়াজ সবজির মূল্যে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

দাম বেড়েছে ২৮ থেকে ৩২০ শতাংশ

মাত্র ছয় মাস আগের কথা। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এসে একই চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজিদরে। মাঝে গুজবের তোড়ে আরো কিছুটা বেড়েছিল অত্যাবশ্যকীয় এই খাদ্যপণ্যের দাম। অথচ এটি কোনো পচনশীল পণ্য নয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন এই দেশে গরিবের খাদ্য মোটা চালের দাম বৃদ্ধির যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই।
এ সময়ে অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে সরু চালেরও। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে যে চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, ছয় মাসের ব্যবধানে বর্তমান দর ৬২ থেকে ৭০ টাকা। সরকারের কড়া নজরদারি আর মজুদদারবিরোধী অভিযানে এই চালের দাম কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু স্বল্প এবং সীমিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস কমছে না। কারণ এক বছর আগে এই চালের দাম ছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। এক বছরে দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ দাম বেড়েছে ছয় মাসের ব্যবধানে।

এ ক্ষেত্রে বাম্পারে আছে পেঁয়াজ। এপ্রিল মাসে খুচরা বাজারে ২৪ থেকে ৩০ টাকা দরে দেশী পেঁয়াজ বিক্রি হলেও ছয় মাসের ব্যবধানে পণ্যটির দাম এখন ৯০ থেকে ১০০ টাকা। ১৮ থেকে ২০ টাকা দামের ভারতীয় পেঁয়াজ বর্তমানে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি করছেন একই বিক্রেতা। অথচ পেঁয়াজের উৎপাদন এবার ভালোই হয়েছে। আমদানিও হয়েছে যথেষ্ট। যদিও দর বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিক্রেতাদের অজুহাত, বৃষ্টির কারণে আগামী মওসুমের পেঁয়াজ যথাসময়ে রোপণ করা সম্ভব হয়নি। এতে আগাম জাতের পেঁয়াজ বাজারে আসতে বিলম্ব হচ্ছে।
একটা সময় ছিল, ভাতের অভাবে দেশের মানুষ কচু-ঘেচু খেয়ে জীবনধারণ করত। কিন্তু বর্তমান সময়টা তাদের জন্য এতটাই নিষ্ঠুর হয়ে দেখা দিয়েছে যে, এক আঁটি কচুর শাক বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা। কাঠকচুর পিস এখন ৪০ থেকে ৫০ টাকা। আর কচুর ছড়া কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়। নভেম্বর মাসে এসেও প্রতি কেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে। বাজারের ভারসাম্যহীনতা এমনপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেড় কেজি মুরগির দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে এক কেজি শিম।

বৃষ্টি এবং বন্যার অজুহাতে কয়েক মাস ধরেই দেশবাসীকে ভোগাচ্ছে সবজির ঊর্ধ্বমূল্য। ছয় মাস আগে যে করলা ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। ১২০ টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে এক কেজি টমেটো কেনার জন্য। ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, কাঁকরোল প্রভৃতি সবজির পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ টাকা। ১০০ টাকা পড়ছে এক কেজি বরবটির দাম। বর্তমানে কিছুটা কমলেও দুই সপ্তাহ আগে এক কেজি লালশাক কিনতে হয়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। আর মরিচের দাম তো নিয়মিত বিরতিতে ২০০ টাকা ছাড়াচ্ছে।
বিভিন্নপর্যায়ের ক্রেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, মাছে-ভাতে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে ছন্দপতন ঘটাচ্ছে চাল-সবজির দরবৃদ্ধি। নি¤œ আয়ের মানুষ আয়ের বড় অংশই খরচ করছেন চালের পেছনে। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি শহুরে জীবনে নিয়ে এসেছে নানা পরিবর্তন। বেড়েছে অন্যান্য খরচও। চালের সূত্র ধরে আয় বাড়াতে রিকশাভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন চালকেরা। দিনমজুরেরা তাদের মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছেন দৈনিক ৫০ থেকে ১০০ টাকা। বাড়তি টাকার জন্য প্রতিদিনই চেঁচামেচি করছেন গৃহকর্মীরা।

ব্যতিক্রম কেবল ভাতের বিকল্প খাদ্য আলু। গত ছয় মাসে সব সবজির দাম ৫০ থেকে ১০০ ভাগ বাড়লেও আলুর দাম উল্টো ১০ টাকা কমেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যে আলু ২৮ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল, বর্তমানে সেই আলুর দাম ১৮-২০ টাকা। লাখ লাখ কৃষকের ভাগ্যের সাথে যুক্ত আলুর দাম বাড়ানোর জন্য তীব্র চাপ থাকলেও সরকার নির্বিকার। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, দেশের ৩৯০টি হিমাগারে থাকা প্রায় ৩০ লাখ টন আলু এখন কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে। বাজারে তেমন চাহিদা না থাকায় এবং কাক্সিত হারে রফতানি না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ কৃষক এবং হিমাগারের মালিক। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে গত কয়েক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ৩৩টি হিমাগার। হতাশ কৃষক ও হিমাগার মালিকের অপমৃত্যুর খবর আসছে প্রতিনিয়তই। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে আসন্ন মওসুমে আলু চাষে কৃষকের আগ্রহ নিয়েও।
বাজার ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনাহীনতার আরেক উদাহরণ রসুন। দ্রব্যমূল্য পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দেয়া তথ্যানুযায়ী, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আমদানিকৃত (চীনা) রসুন বিক্রি হয় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। অথচ এক সপ্তাহ আগেই এ রসুন বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ২৭০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ সরকারি হিসাবেই তখন এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বাজারে বিদেশী রসুনের কেজিপ্রতি দাম বাড়ে ১০০ থেকে ১৩০ টাকা। অথচ এপ্রিলের শেষ দিকে প্রতি কেজি আমদানিকৃত রসুন বিক্রি হয়েছে ২১০ থেকে ২৩০ টাকায়। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে নিত্যপণ্যটির দাম বেড়েছে ৬৭ থেকে ৭৩ শতাংশ।
এরপর শুরু হয় রসুনের উল্টোরথ। খুচরা বাজারে গতকাল শনিবার প্রতি কেজি আমদানি করা রসুন বিক্রি হয় ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা। দেশী রসুনের কেজি ৬০ থেকে ৭০।

দাম কমেছে ফার্মের ব্রয়লার মুরগিরও। খুচরা বাজারে গতকাল ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হয় প্রতি কেজি মুরগি। অথচ তিন মাস আগেও এ মুরগি বিক্রি হয় ১৭০ টাকা কেজি দরে। ছয় মাস আগে বিক্রি হতো ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। বাজারের এমন উত্থান-পতনে প্রতিনিয়তই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে ছোট উদ্যোক্তাদের পথে বসাতে বৃহৎ পুঁজির উদ্যোক্তারা নানা কারসাজিতে লিপ্ত হলেও সরকার বরাবরই নীরব দর্শকের ভূমিকায়।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পণ্যই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে চিনি, আটা, লবণ, বিভিন্ন রকমের ডাল, ভোজ্যতেল প্রভৃতির দাম উল্লিখিত সময়ে বাড়তি কমতির মধ্যে থাকলেও বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটেনি। মাছের বাজারও মোটামুটি স্থিতিশীল। যদিও পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, কৈ, কার্পজাতীয় ফার্মের মাছ ছাড়া নি¤œ আয়ের মানুষের কোনো উপায় নেই। শৌখিন মাছ হিসেবে পরিচিত ইলিশ, আইড়, বোয়াল, রুপচাঁদা, চিংড়ি, টেংরা, বাইন, কোরাল প্রভৃতি কেনার সামর্থ্য কেবল বড়লোকদের জন্য সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই।
নিত্যপণ্যের এই লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন নি¤œ ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ। পরিস্থিতির বর্ণনা করতে গিয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, ব্যবসায়ীরা একেক সময় একেক অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছেন। কখনো বৃষ্টি, কখনো বন্যা, কখনো ঈদ, কখনো রমজান। সমস্যা হলো একবার দাম বাড়লে কমানোর কোনো উদ্যোগ থাকে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাধিক সংস্থা থাকলেও সেগুলো কার্যকর নয় দাবি করে তিনি বলেন, আমাদের ভোক্তারাও সচেতন নন। নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে আমরা সোচ্চার নই বলেই ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো বাজারকে ব্যবহার করছেন। সুযোগ পেলেই দাম বাড়াচ্ছেন আবার প্রয়োজন হলে দাম অস্বাভাবিক কমিয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের পথে বসাচ্ছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/265687