৫ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:৩৫

সমঝোতায় চোরাচালান

৫ গডফাদারের সিন্ডিকেট শনাক্ত * একজনের টাকায় দেশে আসছে ৮০ ভাগ স্বর্ণ * ১১০ গ্রামের বারে লাভ ৫০ হাজার টাকা * চোরাকারবারিদের পক্ষে প্রভাবশালীদের চাপ, অস্বস্তিতে তদন্ত কর্মকর্তারা * চোরাচালান বন্ধে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা চান ব্যবসায়ীরা
আটটি চালানের একটি ধরা পড়বে- এমন শর্তেই দেশে আসছে চোরাই স্বর্ণ। আটক এক চালানে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হলেও বাকিগুলোয় লাভ থাকছে। নতুন শর্তে অবৈধ স্বর্ণের রমরমা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে ৫ গডফাদারের নতুন সিন্ডিকেট। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাই বসে তারা সিন্ডিকেট পরিচালনা করছে। চোরাই পথে আনা ১১০ গ্রাম ওজনের প্রতি বারে মুনাফা হয় ৫০ হাজার টাকা। এক গডফাদারের টাকায় দেশে আসছে ৮০ ভাগ স্বর্ণের চালান। গত কয়েক বছরে এভাবে আনা প্রায় দুই হাজার কেজি স্বর্ণ জব্দ হয়েছে। পাচার হয়ে গেছে এর চেয়ে অনেক বেশি। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে স্বর্ণসহ দেশি ও আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন গডফাদার বিদেশে বসে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে অবৈধ স্বর্ণের রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদ আলী। তার পল্টনের বাসা থেকে ৬১ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। মোহাম্মদ আলী গ্রেফতারের দু’মাস পর জামিনে বেরিয়ে দুবাই বসবাস করছে। সেখানে বসেই দেশে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়াও মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে থাকা ৫ ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে চলছে নতুন সিন্ডিকেট। চক্রগুলো দেশের বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। চোরাচালন চক্রের সদস্যরা দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তার মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা স্বর্ণের চালান বিমানবন্দরের বাইরে নিয়ে আসছে। এরপর পৌঁছে দিচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এর মধ্যে সুনির্দিষ্ট চক্রের ছয়-সাতটি চালান পার হওয়ার পর হয়তো একটি ধরা পড়ছে। ধরা পড়া চালানটি কখনও বড় হয় আবার কখনও স্বর্ণের পরিমাণ থাকে খুবই সামান্য। সবকিছুই হচ্ছে সমঝোতার মাধ্যমে।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (উত্তর) বিভাগের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম যুগান্তরকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন বিদেশে বসে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। ৬১ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার মামলার অন্যতম আসামি মোহাম্মদ আলী এখন দুবাইয়ে বসবাস করছে। আরও অনেকে বিদেশে বসে স্বর্ণের অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। উপকমিশনার বলেন, আমরা এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনার মামলা তদন্ত করেছি। নানা মহলের চাপ উপেক্ষা করে জড়িত অনেক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি সপ্তাহে ২ থেকে ৫টি অবৈধ স্বর্ণের চালান আসছে দেশে। প্রতিটি চালানে অন্তত ৬০টি করে বার আসে। চোরাই পথে আসা স্বর্ণের একটি অংশ কয়েক হাত বদল হয়ে সীমান্তের ওপারে চলে যায়। বাকি স্বর্ণ যায় দেশি ব্যবসায়ীদের হাতে। চোরাচালানের মাধ্যমে আসা প্রতিটি বার (১১০ গ্রাম ওজনের) থেকে ৫০ হাজার টাকার বেশি লাভ করে চোরাকারবারিরা। আর বৈধ পথে কাস্টমস শুল্ক দিয়ে স্বর্ণ আনলে প্রতি বারে লাভ হয় মাত্র ৫ হাজার টাকা। মোটা অঙ্কের লাভের জন্যই অবৈধ পথে স্বর্ণের চালান আসছে। ব্যবসায়ীদের হিসাব মতে, অবৈধ পথে আসা প্রতি বারে খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। অন্যদিকে বৈধভাবে আনলে প্রতি বারে খরচ হয় ৪৭ হাজার টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বর্ণ আমদানির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না।

শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের হিসাবে, গত কয়েক বছরে অবৈধ পথে আসা প্রায় ২ হাজার কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছেন শুল্ক গোয়েন্দারা। এর মধ্যে প্রায় ১৬শ’ কেজি স্বর্ণ এককভাবে উদ্ধার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। এছাড়া পুলিশ, র্যা ব ও অন্যান্য বাহিনীও বিভিন্ন সময় স্বর্ণ জব্দ করেছে।

বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার যুগান্তরকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান চলছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। সমিতির পক্ষ থেকে নীতিমালার জন্য আমরা যে সুপারিশ দিয়েছি, সেটা বাস্তবায়ন হলে অবৈধ পথে স্বর্ণ এনেও তেমন লাভবান হবে না।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১০৫ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনায় দেয়া মামলার চার্জশিটভুক্ত অন্যতম এক আসামি অবৈধ স্বর্ণ ব্যবসার বড় বিনিয়োগকারী। স্বর্ণ চোরাচালান ব্যবসার ৮০ ভাগ বিনিয়োগই তার। গুলশানে আছে তার বিলাসবহুল বাড়ি। এছাড়াও দেশে-বিদেশে আছে সম্পদের পাহাড়। ১৫ বছর ধরে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এই গডফাদার। এই প্রথমবারের মতো স্বর্ণ চোরাচালানের একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

পুলিশ সদর দফতরের হিসাব মতে, ২০১৫ সালে স্বর্ণ চোরাচালানসহ মোট চোরাচালানের মামলা হয়েছে ৬ হাজার ১১৬টি। আর ২০১৬ সালে এ ধরনের মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ৬৭৮টি। তবে চলতি বছরের মামলার সঠিক তথ্য জানাতে পারেনি পুলিশ সদর দফতর। অধিকাংশ মামলাই তদন্তাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস যুগান্তরকে বলেন, চোরাচালান মামলার সঙ্গে আন্তঃদেশীয় চক্র জড়িত থাকে বলে এসব মামলার তদন্ত শেষ করতে বেশি সময় লাগে। স্বর্ণ চোরাচালানসহ সব ধরনের চোরাচালান বন্ধে জড়িতদের গ্রেফতার এবং সঠিকভাবে মামলা তদন্ত শেষ করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে কাজ করছে পুলিশ।

সূত্র জানায়, স্বর্ণসহ চোরাচালান চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের পর তারা নানা কৌশলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে থাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কোনো অভিযানে গিয়ে হয়তো ১০টি বারসহ এক চোরাকারবারীকে আটক করা হল। সেভাবেই কাগজপত্র তৈরি হয়। কিন্তু ওই চোরাকারবারি সিনিয়র অফিসারের সামনে এমনকি আদালতে গিয়েও বলল তার কাছে ১৫টি স্বর্ণের বার ছিল। এ ধরনের ঘটনায় আদালতে এবং সিনিয়রদের কাছে আমাদের বিব্রত হতে হয়। এরপর স্বর্ণ চোরাচালানের তথ্য জানলেও অনেকেই তেমন আগ্রহ দেখান না। এছাড়া গ্রেফতারের পর প্রভাবশালীদের চাপ তো আছেই। তারা বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানিদের গ্রেফতার ও মামলা তদন্ত করতে সমাজের নানা প্রভাবশালী মহল প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। এতে তদন্ত কর্মকর্তারা বিব্রত হন।

নতুন সিন্ডিকেট : মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (উত্তর) বিভাগের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম যুগান্তরকে বলেন, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বসে মোহাম্মদ আলী, মাসুদ করিম, মিন্টু, হামীম ও দিনাজ চোরাচালানের নতুন সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের সিন্ডিকেটে কাজ করছে ফারুক আহমেদ, মীর হোসেন, মো. শাহিন, মো. রেজা, আজমীর, রিয়াজ, আমজাদ, রফিক, মফিজ, এরশাদ, শাহিন, মানিক, মাসুদ, করিম রানা, রহমত বারী, মুরাদ, আজাদ, বিজয় ও লালশ্যাম।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মঈনুল খান যুগান্তরকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আমরা যৌথভাবে কাজ করছি। নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করছি। যেখানেই তথ্য পাচ্ছি, সেখানে সবাই একযোগে কাজ করছি।

তিনি বলেন, স্বর্ণ চোরাকারবারি যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আসতে হবে। কারণ স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে মানিলন্ডারিং জড়িত। তাই এখানে নিরাপত্তার ইস্যুও সামনে চলে আসে। তাই স্বর্ণ চোরাচালান বন্ধে আমাদের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/05/169009