৫ নভেম্বর ২০১৭, রবিবার, ১০:৩২

আশু কোনো সুসংবাদ নেই

চলতে ফিরতে দেখা

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

না নেই। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবিরের বাতাসে কেবলই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। চাপা। গুমরে মরা। তাতে চিৎকার ধ্বনি নেই। ঝড়ো হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দের মতো শিস দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শিশুর ক্রন্দন ধ্বনি। হঠাৎ হইচই। তারপর সব কিছু নিস্তব্ধ। কোথায়ও কোথায়ও জোনাকির মতো জ্বলে হ্যারিকেন কিংবা কুপির আলো। বাতাসের দাপটে নিভে যায় কোনো কোনো আলোর রেখা। অন্ধকার গাঢ় হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যারা এসে আশ্রয় নিয়েছেন, তারা নিঃস্ব। জীবনের সব সঞ্চয়, গোলার ধান, গরু, মহিষ, ছাগল, যানবাহন, জমিনের ওপর দোল-খাওয়া শস্যÑ সব কিছুই এখন তাদের কাছে স্মৃতি। রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সবাই না খেয়ে দিনাতিপাত করেনি। তাদের মধ্যে সম্পন্ন গৃহস্থও ছিল। তাদের জীবনে অভাব বলে কিছু ছিল না; কিন্তু এখন তারা পথের ভিখারি।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বসতি শত শত বছরের। তারা মিয়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মিয়ানমারে আছে ১৩৯টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। রোহিঙ্গা মুসলমানেরাও তাদের একটি অংশ ছিল। কিন্তু ১৯৮২ সালে সেখানকার সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে কার্যত তাদের রাষ্ট্রহীন করে ফেলে। এরপর থেকেই শুরু হয় রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য মৌলিক নাগরিক অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়। সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের লেখাপড়ারও কোনো সুযোগ নেই। মাদরাসা-মক্তব যা ছিল, তা-ও ধীরে ধীরে তুলে দেয়া হয়। মসজিদগুলোকে করা হয় সামরিক ঘাঁটি। বহু ক্ষেত্রেই সেগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন করে তাদের ঠেলে পাঠিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশে। চুক্তি হয়েছিল রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকার ফিরিয়ে নেবে তাদের দেশে। মিয়ানমারের মিথ্যাবাদী সরকার সে চুক্তি মানেনি। আর এবার রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে, যুবকদের নির্বিচারে হত্যা করে, নারী ও নারী শিশুদের ধর্ষণ করে, তাদের ফসলের মাঠ পুড়িয়ে দিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে। মিয়ানমারের তিন ঘনিষ্ঠ সহযোগী চীন, ভারত, রাশিয়া ছাড়া সারা পৃথিবী বলছে, এ এক ভয়াবহ জাতিগত নিধন। এই অবস্থা মেনে নেয়া যায় না।

কিন্তু কী চিত্র বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরের? সে দিকে চোখ রাখা যায় না। কান পাতা যায় না। বাংলাদেশী মানুষ অনাদিকাল থেকে অতিথিবৎসল। আমরা আমাদের অতিথিদের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করি। নিজেরা না খেয়ে হলেও অতিথিদের খাওয়াই। ফলে বুক দিয়ে তাদের আঁকড়ে ধরেছি। হাজার হাজার মানুষ তাদের সাহায্য করার জন্য যার যা সাধ্য তাই নিয়ে ছুটে গেছি উখিয়া টেকনাফের দিকে। কেউ নিয়ে গেছি তাঁবু তৈরির সামগ্রী, কেউ শুকনো খাবার, কেউ ওষুধ বা জ্বালানি। যারা এসেছেন, তাদের বেশির ভাগই নারী, শিশু, বৃদ্ধ। তারা চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে ধিকৃত নোবেলজয়ী সু চি সরকারের পৈশাচিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। কোনো নারীরই অশ্রু শুকিয়ে যাচ্ছে না। কোনো কোনো তরুণী একেবারে চুপ হয়ে গেছেন। নেকাবের ফাঁকে কাজল-কালো দুই চোখ অশ্রুতে টলমল। ভাষা নেই মুখে। রূপ আছে। আভিজাত্যের চিহ্ন আছে। কিন্তু হাসি নেই। ব্যথাতুর চোখে শূন্য দৃষ্টি। সে চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। জিজ্ঞেস করা যায় না, তোমার জীবনে কী ঘটেছে। বুকের ভেতরে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। রোহিঙ্গাদের হৃদয়ে এ আগুন বহু দিন ধরে জ্বলতে থাকবে, বংশ পরম্পরায়।

বাংলাদেশে আরো চার লাখ রোহিঙ্গা আছে কয়েক দশকে ধরে। তাদের আশ্রয়, অন্ন সংস্থান আমরা করে যাচ্ছি। তারা সংখ্যায় আরো বেড়েছে। আরো বাড়বে। এবারো যারা এসেছেন, তাদের মধ্যে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা নারী গর্ভবতী। আরো নতুন সন্তানের জন্ম হবে। তারা সংখ্যায় আরো বাড়বে। তাদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, পয়ঃনিষ্কাষণ আশ্রয়ের দায়িত্ব যদি আমাদের নিতে হয়, তাহলে সে ভার আমরা বইতে পারব তো? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝে বা না বুঝে বলে ফেলেছেন যে, আমরা যদি ষোলো কোটি লোককে খাওয়াতে পারি, তা হলে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকেও খাওয়াতে পারব। পারলে মন্দ হতো না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চিন্তা করেছেন কি, ১৬ কোটি বাংলাদেশীকে তিনি বসিয়ে বসিয়ে ভাত রেঁধে খাওয়াচ্ছেন না। তারা তাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা নিজেরাই করছেন। এদের কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী, কেউ মুটে-মজুর। তারা নিজেদের জীবিকার জন্য সরকারের কাছে হাত পাতছেন না। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কী হবে? তাদের কিন্তু ক্যাম্পে বসিয়ে বসিয়েই খাওয়াতে হবে। এই পরিস্থিতি সামলানো খুব সহজ নয়। এদের বসিয়ে খাওয়াতে হলে প্রতিদিন শুধু চালই লাগবে ১০০ টন। তরিতরকারি, অন্যান্য খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধপত্র লাগবে তারও কত কোটি টাকার। সে হিসাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে আছে বলে মনে হয় না।

ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে শুধু লিপ সার্ভিস ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। রোহিঙ্গাদের পেছনে আগামী ছয় মাসে যা খরচ হবে, তার মাত্র ২৪ শতাংশের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। টাকা বা সহায়তা হাতে পাওয়া যায়নি। একসময় বাংলাদেশের মানুষের সহায়তার ধারাও শুকিয়ে আসবে। যে একবার সাহায্য দিয়ে এসেছে, সে বারবার সাহায্য দিতে পারবে না। কেউ প্রতি মাসে বেতন বা আয়ের একটা অংশ রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ রাখবে না। এটাই খুব স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সরকারের কাছাখোলা পররাষ্ট্রনীতি আর অদূরদর্শী কূটনীতির কারণে। কাছাখোলা পররাষ্ট্রনীতি বলতে এটাই বোঝাতে চাইছি যে, কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই শুধু ক্ষমতায় থাকার লোভে আমরা ভারতকে সব কিছু উজাড় করে দিয়ে দিলাম। ভারতের হাতে তুলে দিলাম ওই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় স্বাধীনতকামী নেতাদের। দিয়ে দিলাম করিডোর ট্রানজিট, সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ, বন্দর। পেলাম না তিস্তার পানি, সীমান্ত হত্যা বন্ধের নিশ্চয়তা। ভারতের সাথে দেনদরবার করার জন্য আমাদের হাতে কোনো মুরগা নেই। আর সে কারণেই ভারত বাংলাদেশের এত বড় বিপর্যয়ে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করল। সে জন্যই প্রত্যেক রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে সব সময় মুরগা থাকতে হয়। শুধু তাই নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার গিয়ে রক্তপিপাসু সু চির সাথে করমর্দন করে এসেছেন। বাংলাদেশের হাতে মোয়া তুলে দেয়ার জন্য তাদের বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে পাঠিয়ে বলিয়েছেন, ভারতীয় এশীয় পররাষ্ট্রনীতিতে ‘বাংলাদেশ সবসে পাহল্’ে। বাংলাদেশের জন্য থাকল তার বুড়ো আঙুল চোষো।
আবার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পর আমরা পরাজিত ও দখলিকৃত দেশের মতো আচরণ করলাম। এক দিকে মিয়ানমার সরকারের বর্বর নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে স্রোতের মতো রোহিঙ্গারা আসছে, অপর দিকে আমরা চাল কিনতে গেলাম মিয়ানমার। আমরা এমন একটা ভাব দেখাতে শুরু করলাম, যেন ওদের সাথে আমাদের কিছুই হয়নি।

এই সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা পর্বত-প্রমাণ। আমি বঙ্গবন্ধুকন্যা, অতএব দুনিয়ার কোনো কিছুই পরোয়া করি না। এটা কোনো কূটনীতি নয়। সরকারের এই মনোভাবের ফলে বাংলাদেশ এখন মুসলিম বিশ্বসহ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী জনশক্তির প্রায় ৯০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে। কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর বদলে ভিন্ন দেশকে সমর্থন দিয়ে তাদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছে। শ্রমিক নিয়োগ তো দূরের কথা, কোনো কোনো দেশ এখন বাংলাদেশীদের ট্রানজিট ভিসা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক দখল করে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) তথা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক শূন্যের কোঠায় নিয়ে গেছে সরকার। নইলে যে সৌদি আরব এর আগে তিন লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছিল, তারা এবার একেবারে মুখ বন্ধ করে আছে কেন?

সর্বশেষ উখিয়া টেকনাফের পরিবেশ। এই এলাকায় লোকবসতি ছিল পাতলা। দূরে দূরে তিন-চারটা বাড়ি নিয়ে ছিল এক একটি পাড়া। তারা তাদের মতো নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করতেন। সেখানে হুট করে ছয় লাখ রোহিঙ্গার বসতি হওয়ায় ওই বাংলাদেশীদের জীবনের শান্তি গেছে। তাদের পদদলিত হচ্ছে ফসলের জমি। উজাড় হয়ে যাচ্ছে বন। রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি বানানোর জন্য, জ্বালানির জন্য বন কেটে উজাড় করছে। যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এখনো গড়ে না ওঠায় বিষিয়ে উঠেছে সেখানকার পরিবেশ। ভেতরে ভেতরে বাড়ছে অপরাধ। তাদের ওই জায়গায় আটকে রাখা সম্ভব হবে না। কোনো-না-কোনোভাবে তারা বাইরে বের হবে। অপরাধ ছড়িয়ে পড়বে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি মনেই করে থাকেন যে, তাদের নিয়ে মিলেমিশে ভাগ করে খাবেন, তবে তাদের বাংলাদেশীদের মূল স্রোতে মিশে যেতে দিন। কাজ করে খাক।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/265568