৪ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:১৬

নিত্যপণ্যের দামে দিশাহারা রাজধানীবাসী

নাগরিক সুবিধার দিক দিয়ে মন্ট্রিয়লের ধারেকাছেও নেই ঢাকা। অথচ জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক দিয়ে বাংলাদেশের রাজধানীর অবস্থান কানাডার ওই নগরীর সঙ্গে এক কাতারে।

বিশ্বের ১৩৩টি নগরীতে জীবনযাত্রার খরচের হিসাব করেছিল যুক্তরাজ্যের দি ইকোনমিস্ট সাময়িকীর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। গত বছরের সেই জরিপে বৈশ্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় সারণিতে ঢাকা ও মন্ট্রিয়লের অবস্থান ছিল ৭১। ব্যয়ের দিক থেকে কানাডার সবচেয়ে বড় শহর টরন্টোও পিছিয়ে ঢাকা থেকে। শহরটিতে জীবনযাত্রার ব্যয় ঢাকার চেয়ে কম, সারণিতে শহরটির অবস্থান ৮৮। মেক্সিকো সিটি, ক্লিভল্যান্ড, ইস্তাম্বুলের মতো শহরেও থাকা-খাওয়ার খরচ ঢাকার চেয়ে কম দেখা গেছে ওই জরিপে। সবচেয়ে সস্তা ১০টি শহরের তালিকায় ভারতের নয়াদিল্লি, মুম্বাইসহ চারটি নগর এবং পাকিস্তানের করাচি থাকলেও বাংলাদেশের রাজধানীর নাম নেই।
প্রবাসী ও বাণিজ্যিক পর্যটকদের খরচের হিসাব ধরে ডলারের মানের ভিত্তিতে ওই জরিপ করেছে ইআইইউ। এর অর্থ একজন বিদেশি পর্যটকের টরন্টো, মুম্বাই বা করাচিতে থাকা-খাওয়াসহ অন্যান্য সেবা পেতে যা ব্যয় হয়, ঢাকায় ওই সেবার জন্য ব্যয় হবে তার চেয়ে বেশি। তবে অন্তহীন নাগরিক সমস্যায় জর্জরিত ঢাকার মানুষের জন্য জীবনযাত্রার এ ব্যয়ের ফারাক আরো বেশি।
স্থানীয় মুদ্রায় প্রতিদিনের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। বৈশ্বিক মানে নিকৃষ্টতম নাগরিক সেবা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে ঢাকার নাগরিকদের। বৈশ্বিক বসবাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকা বিশ্বের চতুর্থ নিকৃষ্ট শহর। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও অবকাঠামোর বিচারে ১০০ নম্বরের মধ্যে গত ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ পেয়ে আসছে ৩৮.৭। এ সূচকে বসবাসের জন্য ঢাকাকে করাচির চেয়েও খারাপ দেখানো হয়েছে।

অথচ এই শহরেই জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের চাপে পিস্ট হচ্ছে নাগরিক জীবন। চাল, পেঁয়াজ, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ার সঙ্গে যোগ হচ্ছে বাড়তি গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাসাভাড়া, যাতায়াত ও শিশুদের পড়াশোনার খরচ। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, গত বছর ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ৬.৪৭ শতাংশ বেড়েছে। এবার যে হারে বাড়ছে চলতি বছর শেষে তা ১০ বছরের বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
রাজধানীর বিভিন্ন সবজির দোকানগুলোতে সাধারণত তিন ধরনের পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এক থেকে দেড় কেজির জন্য ছোট ব্যগ, দুই থেকে আড়াই কেজির জন্য মাঝারি ব্যাগ এবং তিন কেজি থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত পণ্য কিনলে দোকানিরা ক্রেতাকে বড় ব্যগ দেন। এখন কেউ যদি আলুসহ অন্য যেকোনো দুই ধরনের সবজি কেনে তবে তার খরচ পড়ছে ন্যূনতম ১৫০ টাকা। আর আলু পেঁপে ছাড়া যদি তিন ধরনের সবজি কেউ কেনে তবে তার খরচ পড়বে প্রায় ২০০ টাকা, যা দিয়ে ব্যগের অর্ধেকটা ভরে কেবল। কারণ আলু পেঁপে ছাড়া সব ধরনের সবজির দামই এখন কেজিপ্রতি ৬০-৮০ টাকা। কোনো কোনো সবজির দাম ১০০ টাকারও বেশি। বছরখানেক আগেও যখন ২০-৪০ টাকার মধ্যে সবজির দাম ছিল তখন ২০০ টাকা হলে বড় ব্যগটা ভর্তি করেই সবজি নেওয়া যেত বা ১০০ টাকার মধ্যেই তিন ধরনের সবজি কেনা হয়ে যেত।

নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় দেড় শ থেকে দুই শ টাকায় কম সবজি দিয়েই পরিবারের প্রতিদিনের বাজার করছেন মিরপুরের বাসিন্দা শামসুল আরেফিন। মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকের একটি সবজির দোকানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি ৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। তাঁর দেওয়া তথ্য মতে, পাঁচজনের পরিবারে দুই বেলার ভাত রান্নার জন্য প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি চাল লাগে। এতে করে প্রতি মাসে তাঁর পরিবারে চালের প্রয়োজন হয় ৪৫-৫০ কেজি। ৬০ টাকা কেজি দরে এক বস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট চাল কিনতে তাঁর খরচ পড়ছে তিন হাজার টাকা। একই চাল গত বছরের একই সময়ে তিনি কিনেছেন ৪৫-৪৬ টাকা দরে। অর্থাৎ তখন প্রতি বস্তা কিনতে তাঁর ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ২৫০ টাকা। টিসিবির বাজার বিশ্লেষণের তথ্যে দেখা গেছে, মাঝারি মানের প্রতি কেজি মিনিকেট চালে এক বছরের ব্যবধানে ২৫ শতাংশের বেশি বা ১৫ টাকা পর্যন্ত ব্যয় বেড়েছে।

শামসুল আরেফিন তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গত আগস্টে নতুন একটি বাসায় উঠেছেন। দুটি রুম, ড্রয়িং ও ডাইনিং মিলে বাসাটির ভাড়া গুনতে হচ্ছে ১৭ হাজার টাকা। এর ওপর রয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের বিল। বিদ্যুৎ বিল কমবেশি হওয়ার ফলে সব মিলিয়ে ১৯ হাজার টাকার কিছু কম বা বেশি হয়। তিনি জানান, বছর পাঁচেক আগেও মিরপুরে এই সাইজের একটি বাসার ভাড়া পড়ত স্থানভেদে ১০-১২ হাজার টাকা। বাসাভাড়া, নিজের যাতায়াত, পরিবারে খাবার খরচ, বাচ্চার স্কুলের খরচ মেটাতে তাঁকে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানালেন তিনি। শামসুল আরেফিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খরচ যে হারে বাড়ছে তাতে ভালো থাকার কোনো সুযোগ নেই। এখন অন্য চিন্তা করছি। ছোট ভাই আমার সঙ্গে থাকছে। ওর পড়াশোনা শেষ হয়েছে, চাকরি খুঁজছে। ও দ্রুত চাকরি পেয়ে গেলে হয়তো আমার জন্য একটু স্বস্তি আসবে। কারণ দুজনের আয়ে সংসার চললে কিছুটা ভালো চলবে। ’
শামসুল আরেফিনের মতো আরো কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্দিষ্ট করে দু-একটা পণ্যে সমস্যার কারণে দাম বাড়লে সেটা তবু সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু একবারে সব কিছুতেই যখন অস্থির অবস্থা চলে তখন আর ভালো থাকার উপায় থাকে না। সবদিকে বাড়তি খরচের চাপ একসঙ্গে সামাল দেওয়া কষ্টকর। এ দেশে ব্যবসায়ীরা সব সময় ক্রেতাদের বিপদে রাখে। নিয়মের বাইরে সব চলে তাদের খেয়াল খুশি মতো। এর প্রধান কারণ হলো ব্যবসায়ীদের মনিটরিংয়ের আওতায় রাখার কথা যাদের তারাই আসলে ঘুমিয়ে থাকে।
কয়েকজন ক্রেতা অভিযোগ করে, সব সময়ই দেখা যায় যে কৃষক পণ্য উৎপাদন করে তার কপালে ভালো দাম জোটে না। লাভের সবটাই যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। তারা যেভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সেভাবেই চলে। ঢাকা শহরে থাকতে গেলেই অযথা বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে—এটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধানমণ্ডির বাসিন্দা কামরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘নীতিনির্ধারকরা তো এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে। এই যে চালের দাম বাড়ল সেখানে সরকারের সত্যিকারের ভূমিকা নেই। পেঁয়াজের দাম বাড়ছে কেউ কোনো কথা বলছে না। কয় দিন পরপর তেলের দাম বাড়ে। ৬০ টাকার নিচে সবজির দাম নেই—কারও কোনো কথা আছে? নেই। আমরাও এর জন্য দায়ী, কারণ চাপে চ্যাপ্টা হয়ে গেলেও আমরা কোনো কথা বলি না। ’
ক্যাবের দেওয়া তথ্য মতে, ২০০৯ সালে ঢাকা মহানগরীতে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে ৬.১৯ শতাংশ, ২০১০ সালে ১৬.১০ শতাংশ, ২০১১ সালে ১২.৭৭ শতাংশ, ২০১২ সালের ৬.৪২ শতাংশ, ২০১৩ সালে ১১ শতাংশ, ২০১৪ সালের ৬.৮২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৬.৩৮ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৬.৪৭ শতাংশ। তবে বাজার বিশ্লেষকদের ধারণা, শুধু ২০১৭ সালেই যে হারে ব্যয় বেড়েছে তা বিগত ১০ বছরের বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
টিসিবির তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছর হু হু করে ব্যয় বেড়েছে খাদ্য পণ্যের। সাধারণ মানুষের সহনীয় সীমা পার হয়ে যাচ্ছে খাদ্য পণ্যের দাম। চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চালের দাম। গত বছর যে মোটা চাল ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো এখন সেটা ৪৬-৪৮ টাকা। চিকন চাল প্রতি কেজি ৬৮ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ওই চাল গত বছরের এই সময়ে ৫৫-৫৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাসখানেক ধরে অস্থির আছে পেঁয়াজের বাজার। আমদানি করা পেঁয়াজ ৭০ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৮৫-৯০ টাকায়। অথচ ঈদুল আজহার পরে এর দাম ২৫-৩০ টাকায় নেমে এসেছিল। চলতি বছরেই দুইবার বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম। লবণও কিনতে হচ্ছে ৪০-৪২ টাকা কেজি দরে। আর সবজির বাজারে তো আগুন লেগে আছে। প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়, যা গত বছরের চেয়ে অন্তত ১০০ টাকা বেশি।

ক্রেতাদের অভিযোগ, সব জায়গায়ই ব্যবসায়ীরা বলছে নেই। অথচ বাজারে সবই পাওয়া যাচ্ছে। কোনোটার কমতি নেই। এই জিনিসটাই যারা মনিটর করবে তারা চুপচাপ বসে রয়েছে। কোনো কথা বলতে বা কাজ করতে দেখা যায় না তাদের।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে তার তুলনায় এ বছর ব্যাপকহারে বেড়েছে সব কিছুর দাম। তুলনা করলে দেখা যাবে ২০১৭ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বিগত চার-পাঁচ বছরের মধ্যে বেশি হবে। হুটহাট ব্যয় বেড়ে গেলে খুবই সমস্যায় পড়তে হয় নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে। এ বছর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সেটার একটা বড় ব্যর্থতা হচ্ছে সরকারের দূরদৃষ্টির অভাব। পাশাপাশি বাজারগুলোতে তাদের মনিটরিং নেই বললেই চলে। মনিটরিং শক্তিশালী করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরো ভুগতে হবে। ’

http://kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/11/04/561268