৪ নভেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:১২

কথা রাখেনি রাজউক

দরজার চৌকাঠ-পাল্লা দেওয়ার কথা সেগুন কাঠের, কিন্তু দেওয়া হয়েছে গামারি, প্লাইউড বা প্লাস্টিকের। উন্নত ফিটিংসের পরিবর্তে অতি সাধারণ ফিটিংস, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রেও ওই একই অবস্থা। টাইলস ও লিফটের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের ফ্ল্যাটগুলোর অবস্থা আপাতত এ রকম। অথচ একেকটি ফ্ল্যাটের দাম পৌনে এক কোটি টাকা।
অবস্থা বেগতিক দেখে ফ্ল্যাটে আদৌ উঠবেন কি-না ভাবছেন অনেকে। টাকা ফেরত নিতে চাইছেনও কেউ কেউ। কিন্তু টাকা ফেরত নিতে গেলে ধরনা দিতে হবে রাজউকে, কর্তন করা হবে কয়েক শতাংশ অর্থও। সব মিলিয়ে শাখের করাতে পড়েছেন ফ্ল্যাট বরাদ্দপ্রাপ্তরা।

অবশ্য রাজউক দাবি করছে, একটি উপযুক্ত (স্ট্যান্ডার্ড) মান বজায় রেখে কাজ করেছে তারা। ব্যবহৃত ফিটিংসগুলো কারও পছন্দ না হলে নিজ অর্থে বদলে নিতে পারবেন তারা। কোনো আপত্তি করবে না রাজউক।
উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক ও রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, 'ফ্ল্যাটের মূল দরজা চট্টগ্রামের সেগুন কাঠ দিয়ে করা হয়েছে। ভেতরের দরজাগুলো পার্টেক্সের প্লাইউডের। টয়লেটের দরজা প্লাস্টিকের। তবে যেসব কোম্পানি এগুলো সরবরাহ করেছে স্ট্যান্ডার্ড মেনেই তৈরি করেছে তারা। লিফটের ক্ষেত্রে চায়নিজ লিফট ব্যবহার করা হয়েছে, যেটা সর্বত্রই ব্যবহার করা হয়।'
ফ্ল্যাট বরাদ্দপ্রাপ্ত একাধিক ব্যক্তি বলেছেন অন্য কথা। তারা যে স্বপ্ন নিয়ে রাজউকে ফ্ল্যাটের আবেদন করেছিলেন, ভেঙে গেছে সে স্বপ্ন। যেসব সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো টিকবে না বেশি দিন। মানও সন্তোষজনক নয়। এগুলো বদলাতে গেলেও অন্তত ৫-৭ লাখ টাকা খরচ হবে। রাজউক আগে জানালে তারা ইচ্ছামতো কাজ করে নিতে পারতেন, যেভাবে ডেভেলপাররা তাদের ক্রেতাদের সুযোগ দেন। এ প্রসঙ্গে আনোয়ার হোসেন বলেন, 'এতগুলো ফ্ল্যাট প্রত্যেকের পছন্দমতো করতে গেলে এক যুগেও কাজ শেষ করা যেত না।'
বরাদ্দপ্রাপ্ত একজন জানান, রাজউক ফ্ল্যাটপ্রতি ইউটিলিটি ফি (পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ) নির্ধারণ করেছে দুই লাখ টাকা। পার্কিং ফি ধরেছে তিন লাখ টাকা। পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ ফি এত টাকা কোনোভাবেই হতে পারে না। বেসরকারি ডেভেলপাররাও এত চার্জ নির্ধারণ করে না। আর এখনও অনেক ভবনে দুই লাখ টাকায় পার্কিং কিনতে পাওয়া যায়।
জানা যায়, অল্প জায়গায় বেশি মানুষের বাসস্থানের উদ্দেশ্যে ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরে ছয় হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য আবেদন আহ্বান করে রাজউক। সে সময় আবেদনকারীরা তিন লাখ টাকা জামানত দিয়ে আবেদন করেন। ১৬৫৪ বর্গফুটের প্রতিটি ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের দাম ধরা হয় তিন হাজার ৮০০ টাকা। তখন বলা হয়েছিল- তিনটি বেডরুম, চারটি বারান্দা, চারটি টয়লেট, ড্রইং-ডাইনিংসহ প্রতিটি ফ্ল্যাটে থাকবে অত্যাধুনিক ফিটিংস। সব দরজা হবে সেগুন কাঠের। মোট দাম পড়বে ৬৭ লাখ ৮৫ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু আবেদনকারী কম হওয়ার কারণে পরে দাম ৩৫০০ টাকা বর্গফুট নির্ধারণ করা হয়। তাতেও দাম পড়ে ৫৭ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে পার্কিং ও ইউটিলিটি ফি বাবদ ৫ লাখ টাকা। রেজিস্ট্রি খরচ আনুমানিক ৭ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম পড়ছে ৭০ লাখ টাকার মতো। সে সময় ৬ হাজার ১০৯টি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয় রাজউক। কিন্তু ফ্ল্যাটের অবস্থান ও দুর্বল নির্মাণশৈলীর বিষয় বিবেচনা করে এক হাজার ৬৩০ জন আবেদনকারী জামানতের টাকা তুলে নেন। ১৫৫ জন কিস্তি পরিশোধ না করে চুপ থাকেন। যারা কিস্তি পরিশোধ করেননি ইতিমধ্যে বাতিল হয়েছে তাদের ফ্ল্যাট। তাদের ক্ষেত্রে বকেয়া কিস্তির ওপর ৯ শতাংশ সুদ দিয়ে আবেদন করে ফ্ল্যাট নেওয়ার সুযোগ রেখেছে রাজউক। সর্বশেষ গত ১১ সেপ্টেম্বর ৮৩৭ জনকে লটারির মাধ্যমে 'এ' টাইপের ফ্ল্যাটের নম্বর বুঝিয়ে দেয় রাজউক। যারা পেয়েছেন, তারা সরেজমিন ফ্ল্যাট দেখতে গিয়ে হতাশ।

গত সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, পাশাপাশি গোটা পঞ্চাশেক বহুতল ভবনের সারি। প্রতিটি ১৬ তলা। কোনোটিতে প্লাস্টারের কাজ, কোনোটিতে টাইলস ফিটিংয়ের কাজ করছেন শ্রমিকরা। এরই মধ্যে ১০টি 'এ' টাইপের মধ্যে চারটি ভবনের ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেগুলোরও অনেক কাজ বাকি। বরাদ্দপ্রাপ্তদের অনেকে ফ্ল্যাট দেখার জন্য যাচ্ছেন। কিন্তু ফ্ল্যাটগুলো তালাবদ্ধ থাকায় দেখতে পারছেন না। অসম্পন্ন ফ্ল্যাট ঘুরে নিজের ফ্ল্যাট সম্পর্কে ধারণা নিচ্ছেন। তারা বলছেন, বেডরুমের সংখ্যা ঠিক থাকলেও ভেতরের ড্রইং-ডিজাইন সন্তোষজনক নয়। প্রধান দরজা ও চৌকাঠে এমন গাঢ় রঙ ব্যবহার করা হয়েছে, বোঝার উপায় নেই সেটা কী কাঠ। অনেকেই মেহগনি বা গামারি হিসেবে ধারণা করছেন। বারান্দার দরজাগুলোর ফিটিং হয়েছে দুর্বল। অনেক স্থানে ফাঁকা হয়ে আছে। ভেতরে ব্যবহার করা হয়েছে বার্মাটিক টাইপের দরজা। টয়লেটে সাধারণ মানের প্লাস্টিক ডোর। দরজার সিটিকিনিগুলোও খুবই দুর্বল। দুই ফুট বাই দুই ফুট আকারের টাইলস ব্যবহার করা হলেও রঙ ও মান দুর্বল। প্রতি বর্গফুটের দাম কোনোভাবেই ৭০ টাকার বেশি নয় বলে অভিযোগ করেন অনেকে। বিদ্যুতের সুইসবোর্ড, ফ্যানের রেগুলেটর, কলিং বেলের সুইস, জানালায় ব্যবহৃত কাচ, পর্দার ফিটিংস একেবারেই সাধারণ। সিঁড়ির রেলিংয়ের অনেক স্থানেই মরিচা ধরে গেছে। ভবনগুলো থেকে বের হওয়ার সামনের রাস্তার বেহাল দশা।

বরাদ্দপ্রাপ্তরা বলেন, ফ্ল্যাটে উঠলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই মূল শহরের সঙ্গে। রাস্তা তৈরি হলেও সেগুলো ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। কোনো গণপরিবহনের ব্যবস্থা নেই। কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে মেট্রো রেলের স্টপেজ হওয়ার কথা থাকলেও কবে নাগাদ শেষ হবে ঠিক নেই তার। লিফট চালু হয়নি এখনও। গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার কথা থাকলেও গ্যাস নেই। সংযোগ নেই বিদ্যুতের। কয়েকটিতে পানির লাইন দেওয়া হলেও নেই বেশির ভাগ ফ্ল্যাটে।
এসব প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, 'গ্যাস সংযোগ দেওয়ার বিষয়টি সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে এলপিজি গ্যাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রতিটি ফ্ল্যাটে সংযোগ দেওয়া হবে। মিটার থাকবে। ব্যবহার অনুযায়ী তারা বিল পরিশোধ করবেন।'
ইউটিলিটি ফি বেশি নির্ধারণ প্রসঙ্গে বলেন, 'যারা পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের লাইন নিজেদের বাসাবাড়িতে নেন, তাদের ঘুষই দিতে হয় এক-দুই লাখ টাকা। একটা গ্যাসের লাইন নিতে গেলে বোঝা যায় কত টাকা ঘুষ লাগে। কাজেই ইউটিলিটি ফি দুই লাখ টাকা কোনোভাবেই বেশি নয়। বরং অনেক কম।'

অর্ধেক টাকা দিলেই ফ্ল্যাটে উঠতে পারবেন বরাদ্দপ্রাপ্তরা: বরাদ্দ পেয়েও ফ্ল্যাট বুঝে নেওয়ার ব্যাপারে অনেকের অনাগ্রহের কারণে রাজউক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মোট মূল্যের অর্ধেক পরিশোধ করলেই ফ্ল্যাটের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হবে বরাদ্দপ্রাপ্তকে। বাকি টাকা পরে কিস্তিতে বা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হবে। সর্বশেষ ৮৩৭ জনের ক্ষেত্রেও এমনটা করা হয়েছে। যারা মোট মূল্যের ২৭ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন লটারির মাধ্যমে, ফ্ল্যাটের নম্বর দেওয়া হয়েছে তাদেরকেই। যিনি চাইবেন আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বুঝে নিতে পারবেন ফ্ল্যাটের চাবি। তবে ইউটিলিটি ও পার্কিং বাবদ পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
কয়েকজন বরাদ্দপ্রাপ্ত বলেন, ওখানে ৩০ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি হবে বলে শুনেছেন। প্রতি ফ্ল্যাটে পাঁচজন বাস করলেও দেড় লাখ লোক বাস করবে। সকালে যখন সবাই কাজে বের হবেন, তখন অবস্থা কী হবে তা নিয়ে শঙ্কিত তারা। এত মানুষের বের হওয়ার মতো রাস্তাও রাখা হয়নি ভেতরে। ফলে উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প ইট-কংক্রিটের বস্তিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে অনেকখানি।

http://samakal.com/capital/article/1711177