৩ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৯:০৫

সবার অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায় জাতিসংঘ

জাতিসংঘের বিদায়ী আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিন্স বলেছেন, বাংলাদেশে এখন নির্বাচনের সুবাতাস বইছে। জাতিসংঘ প্রত্যাশা করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি কেবল অংশগ্রহণমূলক নয়, এটি অবাধ এবং সুষ্ঠু হবে। একটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘ এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন দেখতে চান জানিয়ে বলেন, কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের বিষয়ে দেশের জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুসংহত ও শক্তিশালী করতে জাতিসংঘের সহায়তা অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে আমরা আমাদের ম্যান্ডেট অনুযায়ী স্টেক হোল্ডারদের উৎসাহ দিয়ে থাকি। জাতিসংঘ আওতার বাইরে গিয়ে কখনো কোনো কাজ করে না।

কূটনৈতিক সংবাদদাতা সমিতি আয়োজিত মতবিনিময় অনুষ্ঠান ডিকাব টক-এ অংশ নিয়ে তিনি গতকাল এসব কথা বলেন। কূটনৈতিক জোন বারিধারার একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ডিকাব টক সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সভাপতি রেজাউল করিম লোটাস। স্বাগত বক্তৃতা করেন সাধারণ সম্পাদক পান্থ রহমান। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ দূত সমসাময়িক বিভিন্ন সময়ে কথা বলেন। তবে নির্বাচন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণ এবং রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তিনি তার স্পষ্ট মূল্যায়ন তুলে ধরেন। জাতিসংঘ দূত বলেন, নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের অনেক দেশকেই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর অসাধারণ উন্নতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অপরাধীদের চিহ্নিত করা, এটা হচ্ছে। বিদায়ী দূত বলেন, বাংলাদেশে দায়িত্ব নেয়ার পর যে বিষয়টিতে আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম তা হলো এখানে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান চেষ্টা! বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে এটি অনেক ক্ষেত্রে কেউ কেউ অস্বীকার করার চেষ্টা করছিলেন। ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছিল। কিন্তু হলি আর্টিজান ঘটনায় পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হয়। এখন আমরা অনেক নিশ্চিন্ত বোধ করি। সরকারও সমস্যাটি স্বীকার করে নিচ্ছে। আর এ নিয়ে পুরো সমাজ ভূমিকা রাখছে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেই সঙ্গে সব বাংলাদেশি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আমি দেখছি অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। সমস্যাটি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত না হয়ে গেলেও এটি আর সমস্যা হিসেবে থাকবে না বলে আমি আশাবাদী। নিরাপত্তার পাশাপাশি বাংলাদেশের আরো কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন চায় জাতিসংঘ। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ সকল পক্ষের সঙ্গে কাজ করছে। আর এটির বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে, মিয়ানমারের অভিযোগ অবাস্তব: রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বিশেষ করে তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে সংকটের স্থায়ী সমাধান পেতে বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে জানিয়ে জাতিসংঘ দূত রবার্ট ওয়াটসকিন বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের জন্য বাংলাদেশ মোটেও দায়ী নয়। এ সংকট প্রলম্বিত করার অভিযোগও বাস্তবসম্মত নয়। বাংলাদেশ সংকট নিরসনে শুরু থেকেই জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। জাতিসংঘ অনুসন্ধান দলকে রাখাইন পরিদর্শন করতে না দিয়ে মিয়ানমারই বরং অসহযোগিতা করছে। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখন দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পরিণত হয়েছে। স্বল্প সময়ে এ সংকটের সমাধান সম্ভব হবে না। তবে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের উপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট হঠাৎ করে শুরু হওয়া কোনো সংকট নয়। আশির দশক থেকেই এ সংকটের শুরু। তখন থেকেই জাতিসংঘ এ সংকট সমাধানের জন্য নানা পর্যায়ে কাজ করছে। তবে গত ২৫শে আগস্টের পর থেকে এ সংকট প্রবল আকার ধারণ করেছে। এখন পর্যন্ত ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে। এই মুহূর্তে শরণার্থী সংকট বাংলাদেশের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। এই রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসন ছাড়া সংকটের কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়। কেবল ফেরতের জন্য ফেরত নয়, তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে ফেরতের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা আবার ফিরে না আসে। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সত্য যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এখন পর্যন্ত রাখাইনে গণহত্যা বন্ধে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে স্বল্প সময়ের ভেতর তিন দফা আলোচনা হয়েছে এবং রাখাইনে গণনিষ্ঠুরতার নিন্দাও জানানো হয়েছে। জাতিসংঘ তার ব্যবস্থার মধ্যে যতটা সম্ভব রাখাইনে নিষ্ঠুরতা বন্ধ এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের প্রতি চাপ অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া জাতিসংঘ জরুরি মানবিক সহায়তা নিয়ে সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। জাতিসংঘের বর্তমান কাঠামোয় নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ প্রভাবশালী রাষ্ট্রের কাছেই যেখানে সব ক্ষমতা, এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সংকট নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখার বাস্তবতা কতটুকু জানতে চাইলে রবার্ট ওয়াটসকিন বলেন, সংকট নিরসনে বর্তমান কাঠামোর ভেতর থেকেই জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে। আন্তর্জাতিক অনুদান পাওয়ার প্রত্যাশায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে বিলম্ব করছে মিয়ানমারের এক মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাতিসংঘ দূত বলেন, এ ধরনের বক্তব্য কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। রাখাইনে বিপন্ন মানুষের জন্য ত্রাণ সরবরাহ কাজ সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না মিয়ানমারের নানা রকম বাধা-নিষেধের কারণে এমনটি জানিয়ে জাতিসংঘ দূত বলেন, বাংলাদেশ প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বের সামনে উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। অতএব বাস্তবতাই বলে দিচ্ছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কারও এ ধরনের বক্তব্য যৌক্তিক নয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার উদ্যোগের সঙ্গে জাতিসংঘ নানাভাবে যুক্ত আছে। আরো সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার প্রয়োজন হলে অবশ্যই থাকবে। কক্সবাজারে খুব কম জায়গার মধ্যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি স্বাস্থ্যগত এবং পরিবেশগত বিপর্যয়ের সৃষ্টি করতে পারে। এমন আশঙ্কায় জাতিসংঘ দূত তাদের সরিয়ে নেয়ার তাগিদ দেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=90318