৩ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৯:০০

হত্যায় ব্যবহৃত অবৈধ পিস্তলটি পৌর যুবলীগ সভাপতির!

গাজীপুরের কালীগঞ্জে সাবেক এমপি মোখলেছুর রহমান জিতু মিয়ার ছেলে হাবিবুর রহমান ফয়সাল হত্যায় ব্যবহৃত অবৈধ পিস্তলের মালিকানা নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কালীগঞ্জ পৌর যুবলীগের সভাপতি বাদল হোসেন তার ভাই এনামুল হক মনুকে পিস্তলটি কিনে দিয়েছিলেন। মনু তার সহযোগী মো. হুমায়ুনকে অবৈধ পিস্তলটি দেন। হুমায়ুন শুটার তৌহিদুল ইসলাম রিমনকে দিয়ে হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করেন। ঘটনাস্থলে হুমায়ুনও উপস্থিত ছিলেন। কিলার তৌহিদুল ইসলাম রিমনের জবানবন্দিতে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ৭ আগস্ট আদালতে তিনি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রিমন তিন মাস আগে জবানবন্দি দিলেও মনু সম্প্রতি সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়ার পর এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তদন্তের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, কিলার রিমন আদালতে জবানবন্দি দিলেও এখনও ফয়সাল হত্যারহস্য অজানা। আর পৌর যুবলীগ সভাপতি পিস্তলের মালিকানা অস্বীকার করেছেন।

এদিকে হত্যা মামলার বাদীকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও পৌর কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র ঘোষ। মামলার বাদী ফয়সালের বোন মাসুমা সুলতানা মুক্তা উত্তরা পশ্চিম থানায় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ২১ সেপ্টেম্বর সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছেন। প্রাথমিক তদন্তে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ জিডির সত্যতা পেয়েছে। কালীগঞ্জ থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আদালত ওই জিডি তদন্ত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন।
রিমন তার জবানবন্দিতে বলেছেন, হুমায়ুনের ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল ফয়সালের। এ কারণে পিস্তল দিয়ে ফয়সালকে ভয় দেখাতে হুমায়ুন তাকে নিয়ে যান। এক পর্যায়ে ফয়সালকে গুলি কমরন রিমন। তিনি জবানবন্দিতে হত্যার এ কারণ উল্লেখ করলেও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা প্রকৃত কারণ নয়। মামলার বাদীকে মোবাইল ফোনে হুমকি দেয়ার বিষয়টিও রহস্য তৈরি করেছে। তাছাড়া হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি যুবলীগ নেতা বাদল তার ভাই মনুকে কিনে দিয়েছিলেন।
মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রেমঘটিত যে বিরোধের কথা বলা হচ্ছে তা হত্যার কারণ নয় এটা নিশ্চিত। ফয়সাল সাবেক এমপিপুত্র হলেও অনেক নিরীহ ছিলেন। তিনি রাজনীতি করতেন না। তার সঙ্গে কারও শত্রুতা রয়েছে এমনটাও জানা নেই। তবে কালীগঞ্জ বাজারের তিন কাঠা জমি তিনি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। জমিটি বিক্রির জন্য স্থানীয় চিকিৎসক নয়ন কুমার চাকীর সঙ্গে ৩৭ লাখ টাকার চুক্তি হয়। ফয়সালকে তিনি ৫০ হাজার টাকা বায়নাও করেন। এর সাক্ষী ছিলেন কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র ঘোষ ও কিসমত নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, জমি বিক্রির চুক্তির পর ফয়সালকে দেয়ার নাম করে নয়ন চাকীর কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা নিয়েছিলেন পরিমল। এ নিয়ে ফয়সাল ও পরিমলের বিরোধ তৈরি হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনও অকাট্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। চাকী ও পরিমল কেউ বিষয়টি স্বীকার করেননি।

মামলার বাদী ও ফয়সালের বোন মাসুমা সুলতানা মুক্তা যুগান্তরকে বলেন, ফয়সালের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে কারও বিরোধ ছিল এমন তথ্য আমরা জানি না। তবে স্থানীয় কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র ঘোষ মামলার আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। তিনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন, ফয়সালের মতো আমাদের পরিবারের সদস্যদের তিনি হত্যা করবেন। পুলিশকে বিষয়টি জানিয়েছি।
স্থানীয় চিকিৎসক নয়ন কুমার চাকী যুগান্তরকে বলেন, ফয়সাল জমি বিক্রি করবে কিন্তু তার কাছে জমির কোনো কাগজপত্র ছিল না। পরে আমি ফয়সালের ঘনিষ্ঠ কিসমতের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিসমতের কাছে ওই জমির কাগজপত্র ছিল। পরে কিসমত ও পরিমলের মধ্যস্থতায় জমি বিক্রির চুক্তি হয়। আমি ৫০ হাজার টাকায় বায়না করি। পরে ফয়সালকে আরও ৬ হাজার টাকা দিয়েছি। ফয়সাল ছাড়া আমি কারও সঙ্গে অর্থ লেনদেন করিনি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মুজিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আসামি রিমন ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে হত্যার যে কারণ বলেছেন তদন্তে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
পুলিশের কালীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পঙ্কজ দত্ত যুগান্তরকে বলেন, ফয়সাল হত্যার ঘটনায় রিমন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। যাদের নাম এসেছে তদন্ত করে দেখছি। আসামি হুমায়ুনকেও গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। হুমায়ুন হত্যার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানাননি।
রিমন স্বীকারোক্তিতে নাম আসা কালীগঞ্জ পৌর যুবলীগের সভাপতি বাদল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, রিমন স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, পিস্তলটি তিনি হুমায়ুনের কাছ থেকে নিয়েছেন। হুমায়ুনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তিনি পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন। হুমায়ুন পুলিশকে পিস্তলের বিষয়ে কিছু বলেননি। এই অস্ত্র দিয়ে এক বছর আগে আমার ওপরও হামলা করেছিল রিমন। সে এটা কোথায় পেয়েছে আমি জানি না।

কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি স্থানীয় কাউন্সিলর পরিমল চন্দ্র ঘোষ যুগান্তরকে বলেন, ফয়সাল নিজে মাদকসেবী ছিলেন। যারা তাকে হত্যা করেছে তারাও মাদকসেবী। ফয়সাল ও খুনিরা একসঙ্গে মাদক সেবন করেছিল।
আপনি বাদীকে হুমকি দিচ্ছেন কেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কেন তাকে (বাদী) হুমকি দেব। তিনি (বাদী) রাতে থানায় এসে উচ্চবাচ্য করতেন। এতে পুলিশ এলাকায় অভিযানের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করত। তাই একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি বাদীকে বলেছি, আপনি দিনের বেলায় থানায় আসবেন। রাতে এসে এভাবে পুলিশকে উত্তেজিত না করতে বলেছিলাম। তিনি তো শুধু আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে জিডি করেছেন। আমি তো তাকে মোবাইল ফোনে পরিচয় দিয়েই কথা বলেছি।

স্থানীয় সূত্র বলছে, ফয়সালকে গুলি করে হত্যার পর কিলার রিমন বিষয়টি পরিমলকে মোবাইল ফোনে জানান। পরে পরিমল খুনের বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছেন। সন্ত্রাসী রিমন এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা পরিমলের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। অপরদিকে হুমায়ুন পৌর যুবলীগ নেতা বাদলের ঘনিষ্ঠ। স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ নেতা পরিমল ও যুবলীগ নেতা বাদলের বিরোধ রয়েছে। ফয়সাল হত্যার পর একপক্ষ অপর পক্ষকে দোষারোপ করেছিল।
গাজীপুরের কালীগঞ্জের ভাদগাতী এলাকায় ৩০ জুলাই হাবিবুর রহমান ফয়সালকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ১ আগস্ট ফয়সালের বোন মাসুমা সুলতানা মুক্তা কালীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় তৌহিদুল ইসলাম রিমন, নওশাদ, হুমায়ুন, মঞ্জুর, আবদুস সাত্তার ও সাইদুল ইসলামকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে রিমন, নওশাদ ও হুমায়ুনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/11/03/168689