৩ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৫৫

সংলাপের প্রস্তাব নিয়ে টেনশানে ইসি

রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপে উঠে আসা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করছে নির্বাচন কমিশন। আগামী ডিসেম্বরে এসব সুপারিশমালা চূড়ান্ত করবে ইসি। তবে এসব সুপারিশমালা বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকটাই টেনশানে আছে ইসি। এদিকে নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে আবেদন চাওয়া হয়েছে।

ইসি সূত্রমতে, আইনি কাঠামো পর্যালোচনা ও সংস্কার, নির্বাচন-প্রক্রিয়া সহজ ও যুগোপযোগী করা, সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারনসহ মোটাদাগে সাতটি বিষয় সামনে রেখে অংশীজনদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বাকি বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সক্ষমতা বাড়ানো। তবে এগুলোর চেয়ে সংলাপে প্রধান হয়ে উঠেছে নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল রাখা না-রাখা ও সেনা মোতায়েনের মতো বিষয়গুলো।
নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, সংলাপে পাওয়া প্রস্তাবগুলো সমন্বয় করে নভেম্বরেই খসড়া তৈরি করা হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সুপারিশমালা চূড়ান্ত করবে ইসি। সুপারিশগুলো বই আকারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যেগুলো নিজেদের কর্মপরিধিতে পড়বে, সেগুলো নিজেদের মতো করে বিবেচনা করবে ইসি। আর রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়গুলো নিয়ে ইসি কী করতে পারে, তা কমিশন বসে ঠিক করবে। তবে অধিকাংশ বিষয়েই ইসির কিছুই করণীয় নেই বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বল এখন ইসির কোর্টে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি নিজেদের স্বার্থেই কথা বলবে। রেফারি হিসেবে ইসির দায়িত্ব সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। এ জন্য কী কী করতে হবে, তা ইসিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের এ কথা বলার সুযোগ নেই যে এটা-ওটা তাদের এখতিয়ারের বাইরে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা অপরিহার্য, তারা সরকারকে বলবে। সরকার সহায়তা না করলে ইসি যদি মনে করে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাহলে তারা বলতে পারে যে তারা নির্বাচন করবে না।
ইসির সংলাপে দেওয়া প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৫টি দল সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে মত দিয়েছে। এর মধ্যে ১০টি দল সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এটি করতে হলে আইনে সংশোধনী আনতে হবে। ১৯টি দল নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে বলেছে। অন্তত ১৫টি দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছে। এটি করতে হলে সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে। এর আগে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপেও এসব বিষয় প্রাধান্য পেয়েছিল। বিএনপিসহ বিরোধী শিবিরে থাকা দলগুলো বলছে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য এই বিষয়গুলোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে ইসির খুব বেশি করণীয় নেই। তাদের করণীয় হলো এ অবস্থায় কী ধরনের পরিবেশ তারা সরকারের কাছে চাইবে, তার পরিকল্পনা করা। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার যেভাবেই থাকুক, তফসিল ঘোষণার পর থেকে ইসিকে সরকারের ‘সুপারভাইজারি রোল’-এ থাকতে হবে। এটা আইন আকারে থাকা উচিত, যাতে সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকে।
এদিকে নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দিতে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে আগ্রহী দলগুলোকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বলেন, নতুন দল নিবন্ধনে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আবেদন পাওয়ার পর কমিটি তা যাচাই-বাছাই করে দেখবে। নিবন্ধনের শর্তগুলো কারা পূরণ করতে পেরেছে, তা দেখা হবে। এরপর এই বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। সব বিবেচনা করে যেসব দলকে যোগ্য পাওয়া যাবে কমিশন নিবন্ধন দেবে।’
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন দলের নিবন্ধনের জন্য আগ্রহীরা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ইসিতে আবেদন করতে পারবে।

আবেদন যাচাই-বাছাই করে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিবন্ধন দেওয়া হবে। মার্চ মাসে নতুন-পুরনো মিলিয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ-১ এই কার্যক্রম সম্পন্ন করবে বলে রোডম্যাপে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, নতুন দলের নিবন্ধন ছাড়াও বিদ্যমান নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করছে কিনা, তার তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে ফেব্রুয়ারি মাসে দলগুলোর নিবন্ধন বহাল রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নিবন্ধিত দলগুলো তাদের শর্ত মানছে কিনা, তা জানার জন্য শিগগিরই ইসি দলগুলোকে চিঠি দেবে বলে জানা গেছে।
নতুন দলের নিবন্ধনের গণবিজ্ঞপ্তিতে দলগুলোর স্বীয় লেটারহেড প্যাডে আবেদন করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে দলের গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র, প্রতীক লোগো, নির্বাচনি ইশতেহার, বিধিমালাসহ ১০ ধরনের দলিল জমা দিতে বলা হয়েছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ (এ) অনুসারে নির্বাচন কমিশন আগ্রহী দলগুলোকে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিবন্ধন দিয়ে থাকে। আরপিও অনুযায়ী তিনটি শর্তের মধ্যে একটি পূরণ হলে একটি দল নিবন্ধনের যোগ্য বিবেচিত হয়। শর্তগুলো হলো:
১. দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেকোনও জাতীয় নির্বাচনের আগ্রহী দলটি যদি অন্তত একজন সংসদ সদস্য থাকেন।
২. যেকোনো একটি নির্বাচনে দলের প্রার্থী অংশ নেওয়া আসনগুলোয় মোট প্রদত্ত ভোটের ৫ শতাংশ পায়। এবং
৩. দলটির যদি একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ (২১ টি) প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং অন্তত ১০০টি উপজেলা/মেট্রোপলিটন থানায় কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সংবলিত দলিল থাকে।
বর্তমানে দেশে ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। আগে ৪২টি দল নিবন্ধিত থাকলেও ফ্রিডম পার্টির নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। এছাড়া উচ্চ আদালতের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন স্থগিত করা আছে।

গত ২০০৮ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথম রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন-প্রক্রিয়া শুরু হয়। জরুরি অবস্থার সরকারের সময় এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করে। ওই অনুযায়ী আরপিও সংশোধন করা হয়। এতে বলা হয়, দলগতভাবে নির্বাচন করতে হলে সেই দলের নিবন্ধন থাকতে হবে। এর আগে যেকোনও রাজনৈতিক দল দলগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারতো।
এদিকে নিবন্ধনের জন্য গত বছর থেকে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল চেষ্টা তৎপরতা শুরু করেছে। কয়েকটি দল থেকে এ বিষয়ে কমিশনকে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়ে চিঠিও দিয়েছে। কেউ কেউ সাক্ষাৎ করে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। সদ্য সমাপ্ত সংলাপেও অনেক রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কথা বলেছে। তারা দলগুলোর জন্য নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করারও দাবি জানিয়েছে। এছাড়া সভা-সমাবেশেও অনেক রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করতে কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/306061