৩ নভেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৫৪

সিন্ডিকেটের কবলে পেঁয়াজের বাজার

চালের পর এবার লাগামহীনভাবে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। ধাপে ধাপে বৃদ্ধিতে এখন সেঞ্চুরির (শতকের) পথে এই নিত্য পণ্যের দাম। আমদানি করা পেয়াজের দাম ৮০ টাকা হলেও দেশি পেয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলতি সপ্তাহে দাম কমার সম্ভাবনা তো নেই বরং বাড়বে।
পেঁয়াজের ঝাঁজ খাবারের স্বাদ বাড়ালেও, আতঙ্ক বাড়িয়ে চলছে বাজারে। লাগামহীন দামে জনজীবনে অস্থিরতার নতুন মাত্রা যোগ করে চলছে এই ঝাঁজ। আর বাজারে দাম বাড়ার প্রতিযোগীতায়ও এখন শীর্ষে রয়েছে পণ্যটি।
গেল তিন থেকে চার মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি। আর গেলো এক সপ্তাহে তৈরি হয়েছে যেন ভৌতিক অবস্থা।

জানা গেছে, চালের পর এবার পেঁয়াজের বাজারে চালের সিন্ডিকেট স্বক্রিয় হয়ে উঠেছে। আগাম বন্যার অজুহাতে চালের পর এবার তিনগুণ হারে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে পেঁয়াজের দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই সরকারের কোন উদ্যোগ। এতে করে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের বাজার। মজুদ সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে না পারলে এই বাজার আরও লাগামহীন হয়ে পড়বে।
দাম বাড়ার কারণ হিসাবে পাইকারী ও খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ী বলছে, একদিকে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশে বৃষ্টির কারণে প্রচুর পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে মোকামগুলোতে বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মজুদ রেখেছে। এছাড়া আমদানি খরচও বেড়েছে। ফলে হু হু করে দাম বেড়েছে।

এসব সিন্ডিকেটের গুদামে মজুদ রয়েছে কয়েক লাখ টন পেঁয়াজ। হঠাৎ করে পেঁয়াজের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে বাজারে অস্তিরতা তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তারা আমদানি মূল্য বৃদ্ধির অজুহাত দিচ্ছে। অথচ অর্ন্তজাতিক বাজারে পেঁয়াজে দাম বাড়েনি। সরকার চাইলে ভারত ছাড়া অন্য কোন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে পারে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই।
গতকাল শ্যামবাজার, যাত্রাবাড়ি, কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল ও কাঁঠালবাগান বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে।
বাজারে খুচরা পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা আর ভারতীয় পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। আবার কোথায় ১০০ টাকায় দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা গেছে। আর পাইকারী পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে দেশি পেঁয়াজের পাল্লা (৫ কেজি) সাড়ে ৪’শ টাকা আর ভারতীয় পেঁয়াজের পাল্লা সাড়ে ৩শ টাকায়।
সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক বাজার পরিস্থিতির সর্বশেষ ২৩ অক্টোবরে প্রস্তুত করা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিকেজি পেঁয়াজে দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। যা শতাংশের হারে প্রায় ৫৫ শতাংশ।
খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বিক্রি করতে হচ্ছে বেশি দামে। কাঁঠালবাগানের মুদি দোকানদার আতিক বলেন, কারওয়ান বাজার থেকে পেঁয়াজ কিনে আনি। সেখানে দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ২০ থেকে ২৫ টাকা বেড়েছে। ফলে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৯০ থেকে ৯৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।
দাম নিয়ে মোকামের ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে এমন অভিযোগ করে পাইকারীরা জানান, বৃষ্টির কারণে ভারতে কিছুটা দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশি পেঁয়াজে। তবে বড় ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে অধিক মুনাফার আশায় দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়িয়েছেন।

কারওয়ান বাজারের ৪৩ নং আড়ত মিনহাজ বাণিজ্যালয়ের হৃদয় হোসেন বলেন, সম্প্রতি বৃষ্টির কারণে ফরিদপুর, পাবনাসহ উৎপাদনকারী কয়েকটি এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে।
এছাড়া ভারতের পেঁয়াজের ওপর বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মত ভারতেও বৃষ্টিতে পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, দেশটিতে প্রায় ২০ জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন হয়। তবে বাংলাদেশে যে কয়েক জাতের পেঁয়াজ আসে তার মধ্যে সাউথ, বেলুরিয়া পেঁয়াজ অন্যতম। কিন্তু এই দুটি জাতের পেঁয়াজই নষ্ট হয়েছে বেশি। সেজন্য দাম বেড়েছে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
একই মার্কেটের কুতুবপুর বাণিজ্যালয়ের এক বিক্রয়ক্রর্মী বলেন, বৃষ্টি ছাড়াও মোকামের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মাল মজুদ করে। তারা নিজেরাই সংকট দেখিয়ে কয়েকদিন পেঁয়াজ বিক্রি করে না। তখনই দাম বেড়ে যায়।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মার্কেট ফেডারেশনের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব শেখ শামসুল আলম বুলবুল বলেন, দেশে পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় মোকাম হচ্ছে রাজশাহীর তাহেরপুর ও বানেশ্বর, ফরিদপুরের গোয়ালন্দ। এছাড়া পাবনায়ও একটি মোকাম রয়েছে। এসব মোকামে মাঝে মাঝে পেঁয়াজের সংকট দেখা দেয়। তখন পাইকারদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
মোকামের আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে প্রায়ই এমন অভিযোগ শোনা যায়।

জানা গেছে,ভারতই বাংলাদেশের পেঁয়াজ, রসুন,আধা মরিচসহ মসলার বাজার নির্ভর করে। ভারতের বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়লেই বাংলাদেশের বাজারেও বাড়তে থাকে। ব্যাখ্যা একটাই ভারতের বাজারে দাম বেড়েছে। একটি দেশ এভাবে একটি প্রতিবেশি দেশের ওপর নির্ভর করতে পারে না। আর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণেই তাদের ইচ্ছা মত দাম বাড়ে দাম কমে।
সূত্র মতে বাংলাদেশে এসব পণ্যের যে বছর ফলন ভাল হয় সে বছর ভারতেই পণ্যের আমদানি মূল্যও কম থাকে। এতে করে দেশির পণ্যের তুলনায় ভারতীয় পণ্যের দাম কম থাকে। আর এ কারণে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। এতে করে স্থানীয় উৎপাদনকারিরা লোকসানের সম্মুখিন হয়। ফলে পরবর্তী বছর আর ঐ পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ হারায়। এতে পণ্যটির মুল্য বাড়তে বাধ্য।
এ বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে ভারতীয় কৃষকরা পেঁয়াজের কম হওয়ার কারণে রাস্তায় ফেলে দিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল মাত্র ৫ টাকা। বাংলাদেশের বাজারে তাদের পেঁয়াজ তখন বিক্রি হয়েছে ২০-২৫ টাকায়। মাত্র ৪ মাসের ব্যবধানে এমনকি হলো সে পেঁয়াজের দাম বেড়ে দাড়িয়েছে ৮০-৮৫ টাকা।

ভরতের ৪টি রাজ্যে আগাম বন্যা হলেও পেঁয়াজ উৎপাদন হয় এমন রাজ্যে কোন বন্যা হয়নি। তাছাড়া শীত মওসুমেই সারা বিশে^ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। ভারত আর বাংলাদেশে বছরে এক মওসুমেই এই পেঁয়াজের উৎপাদন হয়ে থাকে। তাহলে চলতি বছরের জুন মাসের বন্যায় পেঁয়াজের ওপর কোন প্রভাব পড়ার কথা নয়। এতে বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় এই দাম বৃদ্ধির পেছনে দুই দেশের সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে। কিন্তু এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের দায় কার। সরকার যদি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি না করে বিকল্প কোন দেশ থেকে আমদানি করতে পারে তাহলেই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে পড়বে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ধুপখোলা বাজারে পেঁয়াজ কিনতে গিয়ে রীতিমতো মাথায় হাত পলাশ খালাশীর। অন্যদিনের মতো দাম জিজ্ঞেস না করেই দোকানিকে এক কেজি দেশি পেঁয়াজ দিতে বলেন। দোকানি পলিথিনে ভরে পেঁয়াজ ওজন করে দাম চাইতেই পলাশ বিস্মিত। কয়েক দিন আগের চেয়ে দ্বিগুন দাম! তিনি আর পেঁয়াজ নেননি।
পলাশ বলেন, ‘পেঁয়াজের দাম এত বেশি বেড়ে গেছে, এটা আমি জানতামই না। কী বলে! এক কেজি পেঁয়াজ নিলে ১০০ টাকা শেষ! দরকার নাই পেঁয়াজ খাওয়ার। কদিন পেঁয়াজ না খেলে কিছু হবে না। দাম কমলে খামু।

বেশ কদিন ধরেই পলাশের মতো ক্রেতারা বাজারে এসে হোঁচট খাচ্ছেন। চালের দাম বাড়ল তো কাল মরিচের। তারপর শাকসবজি চড়িয়ে দিয়ে পেঁয়াজ-আদার। দু-চার-দশ টাকার বৃদ্ধি না, একেকটা দেড়-দুই গুণ এমনকি তিনগুণ পর্যন্ত। অসহনীয় এই মূল্যবৃদ্ধি সীমিত ও মধ্য আয়ের ক্রেতাদের অসহায় করে তুলেছে।
মূল্যবৃদ্ধির এই মেরাথন দৌড়ে বাটন এখন রসনার অন্যতম অনুষঙ্গ পেঁয়াজের ঝাঁজে। কিন্তু দাম বাড়তে বাড়তে যে তা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হবে এটা কে ভেবেছিল? লাগামহীনভাবে প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম।
দিন বিশেক আগেও খুচরা বাজারে যে পেঁয়াজ ৩৫ টাকা কেজি বিকিয়েছে, গত শুক্রবার তার দাম ছিল ৮০-৮৫ টাকা। দুই দিন বাদে সোমবার সেই পেঁয়াজের দাম গিয়ে ওঠে ৯৫ টাকায়। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ১০-১৫ টাকা!
আমদানি করা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বড় ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভের অভিযোগ সামনে আনছেন আড়তদাররা। তারা বলছেন, মূলত আমদানি করা পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে বড় ব্যবসায়ীরা দেশি পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সঠিকভাবে বাজার মনিটরিংয়ের অভাব এই জন্য দায়ী বলে মনে করছেন তারা।

সোমবারও বাজার ঘুর পেঁয়াজের অস্থিতিশীলতা শিগগিরই থামার কোনো সুখবর পাওয়া যায়নি বিক্রেতাদের কাছ থেকে। বরং দাম বেড়ে ১০০ টাকা ছুঁইবে বলেই ইঙ্গিত মেলে তাদের ভাষ্যে। নতুন দেশি পেঁয়াজ ওঠার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কেউ কেউ বলছেন, ভারতীয় পেঁয়াজের আমদানি বাড়লে দেশি পেঁয়াজের দাম কমে আসবে। তবে আমদানিকারকরা বলছে নতুন পেঁয়াজ না আসা পর্যন্ত আর পেঁয়াজে দাম কমার কোন সম্ভাবনা নেই।
নি¤œআয়ের মানুষের দাবি সরকার খোলা বাজারে আতপ চাল বিক্রি করলেও তার কোন ক্রেতা নেই। এসব ট্রাকে সরকার পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারে। এতে করে পেঁয়াজের বাজার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু সরকার তা না করে দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
ক্রেতাদের অভিযোগ সরকার যদি মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার না করে তাহলে এ পণ্যটির দাম আরও বাড়বে। কারণ নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসবে আরও তিন মাস সময় লাগবে। এর আগে পেঁয়াজের দাম কমার কোন সুযোগ নেই।

http://www.dailysangram.com/post/306062