২ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৫০

আমদানি-রফতানিতে গতি নেই

বেনাপোল কাস্টমস হাউজ ও স্থলবন্দরের দুর্নীতি অনিয়ম অব্যবস্থা

দেশের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপুর্ণ স্থলবন্দর হচ্ছে বেনাপোল। ভারতের পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম নগর ও বন্দর কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো। মাত্র তিন ঘণ্টায় কলকাতা থেকে পণ্য নিয়ে আসা সম্ভব হয় এই স্থলবন্দরে। সেজন্যই আমদানীকারক ও ব্যবসায়ীদের অত্যন্ত পছন্দ বেনাপোল স্থলবন্দর। কিন্তু কাস্টমস হাউজের দুর্নীতি এবং বন্দরের অনিয়ম অব্যবস্থার কারণে ক্রমাগতভাবে গতিহীন হয়ে পড়ছে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দরটি। কমছে সরকারের রাজস্ব আয়। তাছাড়া একশ্রেণীর কাস্টমস কর্মকর্তার দুর্নীতি ও সীমাহীন হয়রানীর কারণে বেনাপোল স্টেশনের বদলে ভোমরা, দর্শনা ও সোনা মসজিদসহ অন্যান্য স্থলবন্দরের দিকে ঝুকছেন আমদানীকারক ও ব্যবসায়ীরা। তারপরেও টনক নড়ছে না কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষের।

১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্থলবন্দরটিতে দিনে দিনে দুর্নীতি অনিয়ম ও অব্যবস্থার বাসা বেধেছে। শত চেষ্টা করেও তা ভাঙা যাচ্ছে না। এই বন্দর ব্যবহার করে দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বিভিন্ন সময়ে একশ্রেণীর আমদানীকারক, ব্যবসায়ী ও সিএ্যান্ডএফ এজেন্টরা জিরো থেকে হিরো হয়েছেন। সুযোগ পেয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার। অথচ বরাবরই উপর মহল ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগে থেকেছেন তারা ধরা ছোয়ার বাইরে। ঘোষণা বহির্ভুত পণ্য ঢুকিয়ে কিংবা সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার বহু ঘটনা ঘটেছে এই স্থলবন্দরে। আগের সেই সুযোগ নেই সংশ্লিষ্টরা এমনটি দাবী করলেও এখন যা ঘটছে তা কোন অংশেই কম নয়। উৎকোচ দিতে রাজি না হলে কনসাইনমেন্টে ইচ্ছামাফিক ট্যাক্স বাড়িয়ে কিংবা ঘন্টার ঘর ঘন্টা ফাইল আটকে হয়রানী করা হয়। বেনাপোল কাস্টমস হাউজের দুর্নীতি ওপেনসিক্রেট। সেজন্যই এটি ‘ম্যানেজ হাউজ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। কাস্টমস এর একজন সুপার ও দু’জন ইন্সপেক্টর উৎকোচের মোটা টাকা প্রতিমাসে ভাগবাটোয়ারা করেন বলে অভিযোগ। যার একটা অংশ নির্দ্দিষ্ট দালালের মাধ্যমে মুখ বন্ধ রাথতে বেনাপোল ও যশোরের বিভিন্ন সেক্টরের ব্যক্তিবিশেষকে পৌছে দেয়া হয়।

স্থলবন্দর ও কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্রে জানা গেছে, বেনাপোল কাস্টমস হাউজের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি দেয়া, মিথ্যা ঘোষণা ও ঘোষণা বহির্ভুত ভারতীয় পণ্যভর্তি ১৬টি ট্রাক গত অর্থবছরে বেনাপোল সড়ক থেকে যশোর বিজিবি আটক করে। গত অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয়ের টার্গেট পুরুণ করতে পারেনি বেনাপোল কাস্টমস হাউজ। পরে সংশোধিত টার্গেটে পুরণ দেখানো হয়। চলতি অর্থবছরেও টার্গেট পুরণ হবে কিনা তা নিয়ে তা সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এর মূল কারণ দুর্নীতি, অনিয়ম অব্যবস্থা। বাংলাদেশ ও ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে স্থলবন্দরে গত ১ আগস্ট থেকে সপ্তাহে সাতদিন ২৪ ঘণ্টার বিরামহীন বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু বেনাপোল কাস্টমস হাউজ ও বন্দর কর্তৃপক্ষের কারণে দুই মাসের মধ্যেই ওই উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যসসিত হয়। বেনাপোল কাস্টমস ও বন্দরের কর্মকর্তাদের এই ব্যর্থতা নিয়ে কোন তাপ উত্তাপ নেই। কয়েকজন ব্যবসায়ী ও সিএ্যান্ডএফ এজেন্ট দৈনিক ইনকিলাবকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাদের ভাবখানা এমন যে ‘সব মহলকে তো ম্যানেজ করে চলতে হয়, এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য হবে না আর মাস গেলে তো সরকারী বেতনের অসুবিধা নেই, খামাখা মাথা ঘামানোর দরকার কী, আমদানী-রফতানী বাণিজ্য বাড়লো কি বাড়লো না তা দেখার টাইম নেই’।

বন্দরের পণ্যজটের ব্যাপারে নামপ্রকাশ করতে নিষেধ করে কাস্টমস ও বন্দরের দুই কর্মকর্তা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেন। তারা এক বিভাগ আরেক বিভাগকে দায়ী করেন। জানা যায়, পণ্যাগারসহ অবকাঠামো সংকট, ওয়্যারহাউস ও শেড সমস্যা, কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতির তীব্র সংকট আর বন্দর কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা অনিয়মের কারণে সমস্যা ও সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। বেনাপোলে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মতিয়ার রহমান জানান, ২৪ঘন্টার বিরতিহীন কার্যক্রমে সরকার একটা ভালো উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু বেনাপোল স্থলবন্দর ব্যর্থ হলো। আরেক সিএ্যান্ড ব্যবসায়ীর অভিযোগ ‘প্যাকিং ম্যাটারিয়ালের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দফা মোড়কের আলাদা ট্যাক্স ধরার বিধান কোথাও নেই। যা এখানে আছে। তাছাড়া ঘাটে ঘাটে পয়সা গুণতে হয় তা না হলে ফাইল নড়ে না’। মেশিনারিজের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯০ পারসেন্ট পর্যন্ত ডিউটি ধরা হচ্ছে। এতে শিণ্প কলকারখানার জরুরি কাজ বিঘিœত হচ্ছে। এ অভিযোগ এনবিআরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে দেওয়া হয়েছে বলে কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান।তাছাড়া ইচ্ছামাফিক ট্যাক্স ইমপোজ ও ফাইল আটকে রাখাসহ নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে কাস্টমস হাউজে। কনসাইনমেন্ট প্রতি নির্দ্দিষ্ট অংকের উৎকোচ আদায় করা হচ্ছে। তবুও কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেন ‘আমরা পয়সা টয়সা নিই না’। বেনাপোল কাস্টমসের কমিশনার মোঃ শওকাত হোসেন দাবি করেছেন, ‘কাস্টমস হাউজে কোনরূপ দুর্নীতি অনিয়ম অব্যবস্থা নেই। নিয়ম মতোই চলছে সবকিছ’। বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২টি শেড, ট্রাক টার্মিনাল, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, বন্দরের অভ্যন্তরের রাস্তা, ড্রেনেজ নির্মাণের কাজ চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এসব কাজ শেষ হলে বন্দরের গতি আরো বাড়বে।

https://www.dailyinqilab.com/article/102521