২ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৪৮

কষ্টে আছে মানুষ (৪)

খাতের বহর বাজেট তছনছ

সংসারের অনেক খাতের অন্যতম একটি শিক্ষা ব্যয়। পরিবারের এক সঙ্গে দুই তিনজন সন্তান লেখাপড়া করলে এক বোঝা নেমে আসে পরিবারে। শিক্ষা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয় পরিবারের কর্তাকে। রাজধানীসহ গোটা দেশেই শিক্ষা এখন পণ্য হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। আর এ পণ্যের থাবায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে সংসারের খরচে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজেট তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
স্কুলের বেতন, কোচিং ফি, খাতা, কলম, টিফিন এবং যাতায়াত খরচ দিতে গিয়ে কাহিল হয়ে পড়ছেন পরিবার প্রধান। আর স্কুলগুলো কথায় কথায় বেতন বাড়ানো, বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক কোচিং, অনুপস্থিতির জন্য জরিমানাসহ বছরব্যাপী নানা খাতে ফি’র ভার তুলে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে। রাজধানীর নামকরা প্রতিষ্ঠান দনিয়া একে উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিবছর এসএসসিতে ভালো ফলাফল করে বিদ্যালয়টি। ফলে এ বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তি করতে আগ্রহ অভিভাবকদের। কিন্তু বিদ্যালয়টি এখন লেখাপড়ার চেয়ে ব্যবসায় মনোযোগী হয়েছে। এমন অভিযোগ ভূরি ভূরি। এ বিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী ছিল তামান্না। গতবছর এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। বাবা ফরিদ মিয়া ছোটখাটো ব্যবসা করেন। কিন্তু মাসিক বেতন ৫০০ টাকা, পরীক্ষা ফিও ৫০০ টাকা, বাধ্যতামূলক কোচিং ফি ৮০০ টাকা, ভ্যান ভাড়া ৬০০ টাকা দিতে গিয়ে সংসারের বাজেটে টান পড়ে। ফরিদ মিয়া বলেন, আরো রয়েছে বাইরের প্রাইভেট পড়ানোর টাকা। এভাবে একমাস, দু’মাস স্কুলের বেতন দিতে পারিনি। প্রাইভেট মাস্টারকেও টাকা দিতে পারিনি। দুই মাস পর একসঙ্গে অনেক টাকা হয়ে যায়। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে মেয়েকে পড়ালেখা থেকে বিরত রাখি। সংসার চালাতে গিয়ে অর্থ দিয়ে শিক্ষা নামক পণ্যটি আর আমার কেনা হলো না। তিনি আফসোস করে বলেন, স্কুলে বেতন নেন ৫০০ টাকা। এর রসিদ দেন। কিন্তু বাধ্যতামূলক কোচিং ফি নেয়া হয় ৮০০ টাকা। যার কোনো রসিদ দেয়া হয় না। বেতন দেয়ার সময় রসিদের উল্টো পিঠে তা লিখে দেন। ফরিদ মিয়া শুধু অর্থের অভাবে তার মেয়েকে পড়াতে পারেন নি। বলেন, এ আফসোস আমার সব সময় থাকবে। একই বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে চন্দনা। তার পিতা মাসুদ জানান, মেয়ের স্কুলের বেতন ৫৫০ টাকা। ভ্যান ভাড়া ৬০০ টাকা। এরপর প্রাইভেট পড়াতে হয়। স্কুলে যদি ঠিকমতো লেখাপড়া হতো তাহলে প্রাইভেট পড়াতে হতো না। মেয়ের লেখাপড়ার খরচ অনেক কষ্ট করে চালিয়ে নিচ্ছি। নিজের কোনো সাধ-আহ্লাদ পূরণ করি না। স্ত্রীও কোনো সাধ- আহ্লাদের কথা বলে না। কোনো রকমে ডাল, ভাত খেয়ে দিন পার করছি। সবকিছুর দাম বাড়ে। কিন্তু আমার আয় তো আর বাড়ে না। রাজধানীর অন্যতম উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণিতে পড়েন শাহাদাত হোসেনের মেয়ে। তিনি বলেন, গত দুই সপ্তাহ আগে মেয়ে এসে বললেন একসঙ্গে তিন মাসের বেতন আর পরীক্ষা ফি দিতে হবে। ওই কলেজের মাসিক বেতন ২২০০ টাকা। তিন মাসে দিতে হবে ৬৬০০ টাকা। আবার পরীক্ষা ফি ১০০০ টাকা। মোট ৭৬০০ টাকা। কলেজে গিয়ে ক্লাস শিক্ষকের কাছে অনুরোধ করেছি মাসে মাসে বেতন দেয়ার জন্য। তিনি অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেন। অনেকক্ষণ বসে থেকেও অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ধারকর্জ করে আর সংসার খরচ থেকে মেয়ের বেতন আর ফি দিয়েছি। তিনি বলেন, জানেন এই মাসটা আমাদের কত কষ্টে কাটাতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে এখন যে যত টাকা খরচ করতে পারবে সে তত ভালো করবে। মেয়েকে কলেজের খরচের বাইরেও প্রতিদিন দিতে হয় ১০০ টাকা ভাড়া ও টিফিন ফি। আর মাসে চার বিষয়ে কোচিং পড়াতে হয়। সেখানে দিতে হয় প্রতি বিষয়ে ১০০০ টাকা করে। তিনি বলেন, সন্তানকে মেধাবী বানাবেন সেখানেও তো টাকার দরকার। যাদের টাকা আছে তারাই এগিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের মতো মধ্যবিত্তরা পিছিয়ে পড়ছি অর্থের অভাবে। বলতে পারবেন এভাবে কতদূর যেতে পারবো। শুধু অভিভাবকই নন, শিক্ষা নামক পণ্যের থাবায় জর্জরিত হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীও। তারা ছাত্র হয়ে আরেক ছাত্রকে পরিয়ে লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করছে। এমন একজন সোহেল খান। তিনি অনার্সে পড়েন। কিন্তু বাড়ি থেকে যে টাকা দেয় তা দিয়ে মেসে থাকা-খাওয়াই হয় না। কলেজের বেতনসহ অন্যান্য খরচ চালাবেন কিভাবে? সোহেল বলেন, কৃষক পরিবারের সন্তান। বাবাকে আরো টাকা পাঠাতে বিবেকে বাধে। তাছাড়া তিনি কিভাবে দেবেন, সে চিন্তাও করি। শেষমেশ দুটি টিউশনি নিয়েছি। যে টাকা পাই তা দিয়ে খরচ চালাই। মো. মোর্শেদ নামের একজন অভিভাবক বলেন, আমার তিন মেয়ে। তারা তিনজনই লেখাপড়া করেন। আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চালানোই কষ্ট হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে অনার্সে পড়ুয়া বড় মেয়ে একটি কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিয়েছে। তার দেখাদেখি মেজো মেয়েও আরেকটি কোম্পানিতে পার্টটাইম কাজ করে। তারা নিজেরা কষ্ট করে নিজেদের পড়ার খরচ জোগাড় করে। বাবা হয়ে এসব দেখে আমার দুঃখ হয়। কিন্তু কি করবো বলুন। সব মেনে নিতে হচ্ছে। আবদুল লতিফ নামে একজন অভিভাবক বলেন, গ্রাম থেকে শহর, পাড়া, মহল্লায় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে কিন্ডারগার্টেন। ঢাকার প্রতি মহল্লায় ৪ থেকে ৫টি কিন্ডারগার্টেন। এসব বিদ্যালয়ে চার বছরের শিশুকে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। শিক্ষা তাদের কাছে এখন বাণিজ্য হয়ে উঠেছে। প্রতি মাসে তারা কত লাভ হলো গুনে। কিন্তু লেখাপড়ার মান কেমন সেদিকে কারো খেয়াল নেই। এসব কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক বেশিরভাগই গৃহবধূ। অল্প বেতনে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে চলছে বেহাল অবস্থা। এদিকে সরকারের খেয়াল নেই। শুধু বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। লতিফ বলেন, একই মহল্লার একটি কিন্ডারগার্টেনে নার্সারি ক্লাসে বেতন নেয়া হয় ৪০০ টাকা। আবার পাশের স্কুলে নেয়া হয় ৫০০ টাকা। নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই। সরকারের উচিত শহর এবং গ্রাম ভাগ করে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করে দেয়া। পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা। রহিম আলী নামের এক অভিভাবক বলেন, কোথায় যাবো আমরা? চালের দাম বাড়ছে তাতেও টান পড়ছে হিসাবে। কাঁচাবাজারে আগুনের আঁচও লাগে পরিবারে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে তার রেশও পড়ে পকেটে। আর শিক্ষাখাত তো এখন মহামারী হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর পারছি না। এ কথা বলার জো নেই। সন্তানদের মানুষ করতেই হবে। আর তাই সংসার খরচে হাত দেই। কাটছাঁট করি। বাজেট তছনছ করি। কোনোরকমে দিন পার করছি। জানি না এভাবে কতদিন পারবো?

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=90178