বিআইডব্লিউটিসির সিদ্ধান্তহীনতায় নষ্ট হচ্ছে ৬ কোটি টাকার রেকার
২ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৪৫

বিআইডব্লিউটিসির সিদ্ধান্তহীনতা

অযতœ-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে ছয় কোটি টাকার রেকার

অযতœ-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) জন্য কেনা ছয় কোটি টাকার দু’টি রেকার। পাঁচ মাস আগে নির্ধারিত দরদাতা প্রতিষ্ঠান চীন থেকে আমদানি করার পর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান চায়না এসজিএস এবং বুরো ভেরিটাস বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রেকার দু’টি সঠিক আছে মর্মে প্রতিবেদন দেয়ার পরও রহস্যজনক কারণে বিআইডব্লিউটিসি তা গ্রহণ করছে না। ফলে ফেরিঘাটে যানবাহন সরানো বা স্থাপনের কাজে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

নদীবন্দরের পন্টুন স্থানান্তর বা ফেরিতে ওঠানামার সময় বিকল যানবাহনকে টেনে তোলার কাজে ব্যবহারের জন্য গত বছরের আগস্ট মাসে দু’টি ৪০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন রেকার কেনার উদ্যোগ নেয় বিআইডব্লিউটিসি। এ জন্য ভ্যাট-ট্যাক্সসহ ব্যয় ধরা হয় পাঁচ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। দরপত্রের মাধ্যমে রেকার সরবরাহের কাজ পায় মেসার্স বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স। প্রতিষ্ঠানটি চীন থেকে এ রেকার দু’টি কিনে আনে। রেকার ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির তিন সদস্য গত মার্চ মাসে পূর্বজাহাজীকরণ পরিদর্শনের (প্রিশিপমেন্ট ইন্সপেকশন) জন্য রেকার দেখতে চীনে যান। মান পরীার সময় বিআইডব্লিউটিসির শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারা রেকারের শক্তি নির্ণয়ক হাইড্রোলিক উইন্চ ২২ হাজার কেজির জায়গায় ২৫ হাজার কেজি পান। তবে লিফটিংয়ের পরীক্ষার সময় বোম বর্ধিত অবস্থায় নমুনা অনুযায়ী ছয় হাজার ৯০০ কেজি পেলেও বোম বন্ধ অবস্থায় ৪০ টন লিফটিংয়ের ক্ষেত্রে উৎপাদনকারী কোম্পানির দেয়া আন্তর্জাতিক কার্ভ চার্ট অনুসরণ করতে সম্মত হয়নি পিএসআই টিম। রেকারের মূল কাজ পুলিং করা, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়ম অনুযায়ী রেকারের ভারোত্তোলন/লিফটিং করার সময় কার্ভ চার্ট অনুসরণ করতে হয় এবং সেই চার্ট অনুযায়ী ৪০ টন লিফটিং ক্ষমতাসম্পন্ন রেকারের সক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য রেকারের বোমের দৈর্ঘ্য ও এঙ্গেল অনুযায়ী বোম বর্ধিত অবস্থায় ৬.৮ টন উত্তোলন করার নিয়ম আছে। সে ক্ষেত্রে ৪০ টন লিফটিংয়ের সক্ষমতা যাচাইকালে বিআইডব্লিউটিসির টিম কার্ভ চার্ট অনুসরণ না করে প্রায় ২২ টন ওজন উত্তোলনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, যা রেকারের সক্ষমতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত এবং পিএসআই টিমের পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাব বলে চায়নার রেকার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মনে করে। এ ছাড়া রেকার দু’টির অন্যান্য যন্ত্রপাতি বিআইডব্লিউটিসির নমুনা অনুযায়ী সঠিক মানের রয়েছে। এমনকি কোনো কোনোটির ক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি রয়েছে বলে কমিটির সদস্যরা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন দেন। কিন্তু পিএসআই টিম ৪০ টন লিফটিংয়ের ক্ষেত্রে কার্ভ চার্ট অনুসরণ না করায় চায়না রেকার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রেকার দু’টির মান পরীক্ষার জন্য তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ আন্তর্জাতিকভাবে মেশিনারিজের মান নিরূপণকারী প্রতিষ্ঠান এসজিএস চায়না কর্তৃক বিআইডব্লিøউটিসির নমুনা অনুযায়ী রেকার দু’টির লিফটিং এবং পুলিং ক্যাপাসিটি পরীক্ষা করে। এসজিএস প্রতিবেদন প্রদান করে, রেকার দু’টি ৪০ টনের পরিবর্তে ৪৬.৪৩ টন পুলিং ক্ষমতাসম্পন্ন এবং আন্তর্জাতিক কার্ভ চার্ট অনুযায়ী লিফটিং ক্যাপাসিটি ৪০ টন পর্যন্ত।
ওই প্রতিবেদন বিআইডব্লিøউটিসিতে জমা দিলে রেকার দু’টি আমদানির অনুমতি দেয় বিআইডব্লিউটিসি। ঠিকাদারিপ্রতিষ্ঠান গত মে মাসে রেকার দু’টি ঢাকায় নিয়ে আসে। এরপর বিআইডব্লিউটিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও রেকার ক্রয় প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী আবদুল গফুর সরকার গত ২২ জুন এক চিঠি দিয়ে একটি রেকার ভোলার ইলিশা ঘাটে এবং আরেকটি দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে নিয়োজিত রাখার জন্য নির্দেশ দেন। সে অনুসারে রেকার দু’টি সংশ্লিষ্ট ঘাটে পাঠানো হয়; কিন্তু রহস্যজনক কারণে কমিটির সদস্য বিআইডব্লিউটিসির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) নুরুল হুদা হঠাৎ বেঁকে বসেন। বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে রেকার দু’টির মানহীনতার কথা জানান তিনি। নুরুল হুদার আপত্তি অব্যাহত থাকায় রেকার দু’টির মান আবারো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গত ৮ আগস্ট বিআইডব্লিউটিসির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য-১) এন এস এম শাহাদাত আলীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সদস্যরা গত ২৮ সেপ্টেম্বর রেকার পরিদর্শন ও কাগজপত্র যাচাই করেন। এ সময় বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত সব ধরনের মেশিনারিজের পরীক্ষা, পরিদর্শন ও মান নিরূপণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ব্যুরো ভেরিটাসের একজন মনোনীত প্রতিনিধি নিয়ে যান। ব্যুরো ভেরিটাস গত ৪ অক্টোবর প্রতিবেদন প্রদান করে। এতে তারা জানান, ওই রেকারের লিফটিং ও পুলিং ৪০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন এবং বিআইডব্লিউটিসির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সঠিক আছে; কিন্তু এরপরও রেকার দু’টি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেনি বিআইডব্লিউটিসি। দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে রেকার দু’টি খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়েছে। এতে প্রায় ছয় কোটি টাকার দু’টি রেকার অযতœ-অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফেরিঘাটে যানবাহন সরানো বা স্থাপনের কাজেও তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা।

এ প্রসঙ্গে রেকার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী বিল্লাল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, রেকারের বিষয়টি টেকনিক্যাল। কমিটিতে যারা নন-টেকনিক্যাল লোক আছেন, তারাই হয়তো রেকারের মান নিয়ে আপত্তি করেছেন। আন্তর্জাতিক মানের দু’টি প্রতিষ্ঠান দিয়ে রেকার দু’টির সমতা পরীা করানো হয়েছে। রেকার দু’টি বিআইডব্লিউটিসির স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সঠিক আছে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক আবদুল গফুর সরকার নয়া দিগন্তকে বলেন, পিএসআই কমিটির সদস্যদের পরিদর্শনের সময় লিফটিংয়ের ক্যাপাসিটি পরীক্ষার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কার্ভ চার্ট অনুসরণ করার নিয়ম জানা ছিল না। তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক দু’টি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী রেকার দু’টির গুণগত মান সঠিক আছে। এ ব্যাপারে যাচাই-বাছাই কমিটিও কোনো ত্রুটি পায়নি। আশা করছি, দ্রুতই এ ব্যাপারে সমাধান হয়ে যাবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/264768