২ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৩৬

ছাত্র রাজনীতির নামে কিছু যুবক অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত

রাজধানীর পুরান ঢাকার দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। ৮০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় গত মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছে। সরকারের ডেপুটি এটর্নি জেনারেল মো.মনিরুজ্জামান রুবেল রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন গণমাধ্যকে।

বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ গত ৬ আগস্ট নিম্ন আদালতে মৃত্যুদন্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে দু’জনের মৃত্যুদন্ড বহাল, চারজনের মৃত্যুদন্ডের সাহা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং অপর দু’জনকে খালাস দিয়ে গত ৬ আগস্ট রায় দিয়েছিলেন। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে যে দু’জন আপিল করেন, তারা খালাস পান। দন্ডিতরা সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, দেশের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করছে কিছু যুবক। ছাত্র রাজনীতির নামে তারা সংঘবদ্ধভাবে অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত। রাজনৈতিক নেতাদের নিজস্ব এলাকায় আধিপত্যকে ধরে রাখার জন্য মাঝে মাঝে প্রকাশ্যে এবং হিং¯্রভাবে শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন হয়। কিছু তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা তাদের নিজস্ব স্বার্থে ছাত্রদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

আদালত বলেন, আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি যে, সরকারি পরীক্ষায় নকল করার অনুমতি না দেয়ায় তাদের হাতে শিক্ষকরা প্রহৃত হোন। অনেক ছাত্র হলে তারা প্রশাসনিক ক্ষমতা নিজ হাতে নিয়ে নেন এবং সাধারণ ছাত্রদের ভাড়ার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দ দেন। বিপুল অংশগ্রহণকারী প্রকাশের মাধ্যমে তাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করেন। এটি খুবই ভয়ানক, বিপজ্জনক ও হতাশামূলক অবস্থা। জাতি এখান থেকে মুক্তি পেতে চায়।
আদালত রায়ে বলেন, যদিও প্রত্যাশা ছিল যে, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের দায়িত্বশীল জাতীয় নেতারা এসব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করবেন। বিরোধী দলের কার্যক্রমকে দমনের জন্য অবশ্যই যুবক ও ছাত্রদের আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার জন্য উৎসাহিত করা উচিত নয়, যেহেতু এগুলো সাংঘর্ষিক, নৈরাজ্যকর এবং আইনে অনুমোদন নেই। বিরোধী দলের হিং¯্র ও অপরাধীমূলক কার্যক্রম বন্ধ করতে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট। আমাদের উচিত এ মামলার আরো একটি দিক তুলে ধরা,যা আমাদের অপরাধমূলক বিচারব্যবস্থার ভুল তদন্ত প্রতিরোধ করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আদালত আরো বলেন, আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি, যেখানে অভিজাত এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা কিছু দায়মুক্তি ভোগ করে থাকেন এবং তারা সহজে যেকোনো অপরাধ করার পর ওই ঘটনায় তদন্তের ফলাফলের ওপর সহজে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ এবং অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা এবং ডাক্তার বিশেষজ্ঞরা এগিয়ে আসেন অপরাধীকে সাহায্য করার জন্য। এসব ব্যক্তি অপরাধীকে নিখুঁত প্রমাণ করতে মিথ্যা রিপোর্ট প্রদান করে থাকেন।
গত ১৬ মে থেকে হাইকোর্টে এ মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শুরু হয়ে গত ১৭ জুলাই শুনানি শেষ হয়। চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্বজিৎ দাস হত্যার ঘটনায় আনা মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ের বিষয়ে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা।
২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় ৮ জনকে মৃত্যুদন্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন নিম্ন আদালত। ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবিএম নিজামুল হক এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি নিম্ন আদালতের মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামীরা।
মৃতুদন্ডপ্রাপ্তরা হলেন-রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিঞা টিপুন, রাজন তালুকদার এবং মীর মো. নূরে আলম লিমন।
এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্তরা হলেন-এএইচএম কিবরিয়া, ইউনুস আলী, তারিক বিন জোহর তমাল, গোলাম মোস্তফা, আলাউদ্দিন, ওবায়দুর কাদের তাহসিন, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল-আমিন, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, মোশাররফ হোসেন ও কামরুল হাসান। এছাড়া তাদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড করা হয়।
আসামীদের মধ্যে আটজন রফিকুল ইসলাম, মাহফুজুর রহমান, রাশেদুজ্জামান, কাইয়ুম মিয়া, এস এম কিবরিয়া, এমদাদুল হক, সাইফুল ইসলাম ও গোলাম মোস্তফা কারাগারে আটক আছেন।

বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ছাত্রলীগের ২১ কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এই ২১ আসামির মধ্যে ৮ জন কারাগারে এবং বাকিরা পলাতক রয়েছেন।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কুপিয়ে খুন করে বিশ্বজিৎ দাসকে। হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে বিশ্বজিত দাসের দর্জি দোকান ছিলেন। তিনি থাকতেন লক্ষ্মীবাজার। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর।
এই হত্যাকান্ডের পরপরই সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলেছিলেন, ঘটনার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্র শিবির জড়িত। হত্যাকান্ডে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার বিষয়টি বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট হলে সরকারের সংশ্লিষ্টরা তখন অভিযোগ করেন বিশ্বজিতের আত্মীয় স্বজন জামায়াত-শিবির করে।

http://www.dailysangram.com/post/305985