২ নভেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৩৫

শত বছরেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হলো না

কোথাও শিরোনাম ‘ফিলিস্তিনীদের দুঃখের শতবর্ষ’, কোথাও শিরোনাম ‘ফিলিস্তিনীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শতবার্ষিকী’। শিরোনাম যাই হোক, ফিলিস্তিনীদের দুঃখের সাথে জড়িয়ে আছে বেলফোর ঘোষণা। ১৯১৭ সালে ২ নভেম্বর জারি করা বেলফোর ঘোষণাপত্রটি ছিল বেশ সংক্ষিপ্ত। মাত্র ৬৭ শব্দের একটি ঘোষণা। কিন্তু এর কারণে যে সংঘাতের সৃষ্টি হয় তা বর্তমান বিশ্বের জন্য বড় সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ওই ঘোষণার শতবর্ষ পূর্ণ হতে চললেও সংকটের কোন সুরাহা হয়নি। বরং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত এখনো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ অ্যাভি শ্লায়াম প্রসঙ্গত বলেন, বেলফোর ঘোষণায় বৃটিশ সরকারের জন্য গৌরবের কিছু নেই। এই ঘোষণা ছিল লজ্জাজনক ও দুঃখজনক পদক্ষেপ। বৃটিশ সরকারের তাই লজ্জায় মাথা নত করা উচিত।

নির্মম বাস্তবতা হলো, শত বছর পরেও আজ আমাদের বেলফোর ঘোষণা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। এই ঘোষণায় আসলে কী রয়েছে? বেলফোর ঘোষণা ছিল ফিলিস্তিনে ‘ইহুদীদের জন্য একটি জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠায় ১৯১৭ সালে যুক্তরাজ্যের করা একটি প্রতিশ্রুতি। তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এক চিঠিতে বৃটিশ ইহুদি নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে ওই প্রতিশ্রুতি দেন। ফিলিস্তিন সে সময় অটোমান সা¤্রাজ্যের অংশ ছিল। ইহুদিরা সেখানে ছিল সংখ্যালঘু, মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ ছিল তারা। উল্লেখ্য যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) চলাকালীন সময়ে ওই ঘোষণা আসে এবং অটোমান সা¤্রাজ্যের পতনের পর তা বাস্তবায়ন করা হবে বলে এতে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। তথাকথিত এই ম্যান্ডেট ব্যবস্থা মিত্রশক্তির দেশগুলো তৈরি করেছিল যা ছিল আসলে ঔপনিবেশিকতা ও দখলদারিত্বের এক নোংরা রূপ। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সা¤্রাজ্য ও বুলগেরিয়া পরাজিত হওয়ার পর এই ম্যান্ডেটের বলে বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ মিত্রশক্তির কর্তৃত্বে আসে। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে বৃটিশ সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বৃটিশ সরকার ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের ফিলিস্তিনে গিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দিতে থাকে। এর পরের ঘটনা তো সবার জানা।

বেলফোর ঘোষণার কারণে ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনীরা আজ নিজ দেশেই অধিকার হারা। জুলুম-নির্যাতনের পাশাপাশি ক্রমাগতভাবে নিজ আবাসস্থল থেকে ফিলিস্তিনী নাগরিকদের উৎখাত করে যাচ্ছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। আর সেখানে বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে ইহুদিদের জন্য। এমন অন্যায় কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছে বড় বড় রাষ্ট্রগুলো। ফলে ফিলিস্তিনীদের দুঃখের রজনী প্রলম্বিত হচ্ছে, যার শুরু হয়েছিল শতবর্ষ আগে।
শতবর্ষ পরেও পরিস্থিতির গুণগত কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং অবনতিই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চলছে প্রতারণা ও চাতুর্য।
বিশ্ববাসী জানেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকরা নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকে মুসলিম ও ইসলামভীতি প্রকাশ করে আসছেন। তাদের এমন আচরণের কারণ যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমরা বিশেষ করে মুসলিম নারীরা নানা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামের জয়যাত্রা থেমে নেই। দেশটিতে ট্রাম্পের ঘৃণাত্মক ভাষা ব্যবহার বরং অমুসলিমদের মধ্যে ইসলামের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। তারা কোরআন গবেষণায় উৎসাহিত হয়েছেন এবং অনেকেই ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেছেন। ২৮ অক্টোবর এ বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে ডেইলি পাকিস্তানে।

প্রসঙ্গত লিসা শানকিনের কথা উল্লেখ করতে হয়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘৃণাত্মক বক্তৃতা এই মার্কিন নারীকে ইসলাম ধর্মগ্রহণে সহায়তা করেছে। ইসলাম গ্রহণ প্রসঙ্গে সম্প্রতি তিনি ফেসবুকে একটি পোস্ট দিলে তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। লিসা শানকিন একজন সাবেক সাইকোথেরাপিস্ট। তিনি মনোবিজ্ঞানের ওপর শার্লট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করেন। তিনি তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ট্রাম্পের ঘৃণ্য বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি আমাকে এক বছর আগে কোরআন অধ্যয়নে সাহায্য করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক ধর্ম অধ্যয়নের সময়ও এভাবে আমার পড়া হয়নি। আমি গভীরভাবে কোরআন অধ্যয়ন করেছি। শানকিন ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে হিজাব পরা শুরু করেন। এদিন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। শানকিন আরো বলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি তারিখে ট্রাম্প যখন শপথ নিবেন, সেই সময় থেকেই আমার প্রকাশ্যে হিজাব পরা শুরু হবে। উল্লেখ্য যে, বিশ্বের মধ্যে আমেরিকাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ ইসলাম ধর্মগ্রহণ করছেন। নাইন-ইলেভেনের পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ছড়ালে তার ফলাফল কিন্তু মুসলমানদের জন্য মন্দ হয়নি, বরং ইসলামের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে এবং মানুষ এই ধর্মটি গ্রহণও করছে।
ঘৃণা-বিদ্বেষ মানুষের জন্য কাক্সিক্ষত বিষয় হতে পারে না। ঘৃণা-বিদ্বেষ ব্যক্তির সাথে সাথে সমাজের জন্যও ক্ষতিকর। আর এই বিষয়টিও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার জন্য ঘৃণা-বিদ্বেষ কোন কার্যকর অস্ত্র হতে পারে না। বরং ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচারকারী মানুষ নিজের কাছেই ছোট হয়ে যায়। এমন ছোট মানুষের বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করে না। বরং যার প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রকাশ করা হয় তার প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। মানুষ তাকে জানতে চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা তেমন ঘটনাই লক্ষ্য করছি। অতএব মুসলমানদের হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই।

http://www.dailysangram.com/post/305922