১ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:৫৫

আরাকানে জ্বালাও পোড়াও অব্যাহত

রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে মারার হুমকি দিয়ে মাইকিং; নৌকাডুবিতে ৫ শিশুসহ ৭ জনের মৃত্যু

মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আরাকানে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দেয়ার পরও আরাকানে জ্বালাও-পোড়াও অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী রাখাইনরা। গত সোমবার বুচিডংযের নদীতীরবর্তী মগনা পাড়ায় রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে রাতে আগুন দেয় সৈন্যরা। এতে কয়েকটি বসতবাড়ি পুড়ে যায়। এর আগে গত শনিবার মংডুর মরিয়ং ও সুন্দরীপাড়ায় প্রায় ৩০০ বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয় সেনারা। এ দিকে উখিয়া ও টেকনাফের সমুদ্র উপকূলে রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকা ডুবে যাওয়ার পর পাঁচ শিশুসহ সাতজনের লাশ ও ৬৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, আরাকানের বুচিডং অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী ও তাদের লেলিয়ে দেয়া রাখাইনরা। তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করছে। উগ্রপন্থী রাখাইন ও মগেরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরের দামি আসবাবপত্র, স্বর্ণালঙ্কার, টাকা, মোবাইল সেট, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল, গৃহপালিত পশুপাখি ও েেতর ফসল লুট করছে। রোহিঙ্গারা বাধা দিলে দেশীয় তৈরী অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসে রাখাইনরা।
একটি সূত্র জানিয়েছেন, গত সোমবার উপজেলার নদীপাড়ের মগনা পাড়ায় রাতে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দেয় সৈন্যরা। এতে কয়েকটি বসতবাড়ি পুড়ে যায়। সৈনারা চলে গেলে স্থানীয়রা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। এতে সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয়েছেন স্থানীয় মকবুল আহমদের ছেলে আব্দুল হক (৪৫)। এর আগে শনিবার মংডুর মরিয়ং ও সুন্দরী পাড়ায় প্রায় ৩০০ বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয় সেনারা।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আরো জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী ও মগদের অত্যাচার-নির্যাতনে রোহিঙ্গারা বাড়িঘর থেকে বের হতে ও বাজারে যেতে পারছেন না। এ কারণে তীব্র খাদ্যসঙ্কটে পড়তে হচ্ছে তাদের। অনন্যোপায় হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে নাফের পাড়ে এসে অসহায় জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। এখনো সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা গ্রামে গ্রামে মাইকিং করে বলছে, তোমরা সবাই বাঙালি, বাংলাদেশে চলে যাও, না হলে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হবে। এর পর ঘর থেকে বের হয়ে রোহিঙ্গারা পালিয়ে জঙ্গলে ও প্যারাবনে আশ্রয় নেন। সেনারা রাখাইনদের দিয়ে ঘরে তল্লাশি চালায়। যেসব ঘর খালি পেয়েছে সেগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে। দিনের বেলায় সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা যেসব গ্রামে এখনো রোহিঙ্গা অবস্থান করছে তাদের মিয়ানমারের ভাষায় লেখা ‘বাঙালি কার্ড’ (এনভিসি কার্ড ) জোর করে ধরিয়ে দিচ্ছে। অনেকে প্রাণভয়ে এ কার্ড নিয়েছে। আবার কেউ নিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে। এ কারণে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন।

ওই টাউনশিপের দানুপাড়া গ্রামের নুরুল আমিন (৪০) বলেন, আরাকানে আমাদের জন্ম। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, সেখানে আমাদের ঠাঁই হয়নি। বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে হয়েছে। হয়তো সেখানে থাকলে ঘরবাড়ির মতো আমাদেরও আগুনে পুড়িয়ে মরতে হতো। তিনি জানান, দু’দিন আগে রাতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে রাখাইনরা আমাদের কাঠের দোতলা ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ওই গ্রামের মেন বাজারে দুইটি কাপড়ের দোকান ছিল, যা ২০ দিন আগে লুট করেছে তারা। পৃথিবীতে কি আর এমন কোনো দেশ আছে, যেখানে সরকার নিজ দেশের মানুষকে গুলি করে, আগুনে পুড়িয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে?
রোহিঙ্গা তরুণদের জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য আখ্যা দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর তাদের হত্যা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবদুল মতলব জানালেন, গত দুই দিন ধরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় রাখাইনরা বুচিডংয়ের বিভিন্ন এলাকায় রোহিঙ্গাদের এখনো অক্ষত ঘরবাড়িগুলোতে আগুন দিচ্ছে। ফলে জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে নাফ নদীর ওপারে জড়ো হচ্ছেন রোহিঙ্গারা।

এ দিকে মঙ্গলবার সকালে বঙ্গোপসাগরের উখিয়ার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ইমামের ডেইল এবং টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মহেশখালিয়া পাড়া পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের বহনকারী নৌকা ডুবে গিয়ে পাঁচটি শিশু সাতজন মারা যায়। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: নিকারুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানান, সকাল সাড়ে ৭টায় উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের বইল্যাখালী উপকূলে নৌ-দুর্ঘটনায় স্থানীয়দের সহায়তায় শিশুসহ চার রোহিঙ্গার লাশ ও ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে পুলিশ। উখিয়া থানার ওসি মো: আবুল খায়ের বলেন, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় উখিয়ার ইমামের ডেইল এলাকার সাগরে রোহিঙ্গাদের নৌকা ডুবে শিশুসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া সাংবাদিকদের জানান, সোমবার রাতে মহেশখালিয়াপাড়া পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের একটি নৌকা ডুবে যায়। এ সময় স্থানীয় লোকজন ও নৌকায় থাকা রোহিঙ্গারা বেশ কিছু লোকজনকে উদ্ধার করেন। তাদের মধ্যে সাতজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক এক শিশুকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। ছয়জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কক্সবাজার হাসপাতালে পাঠানো হয়। সকালে একই পয়েন্ট দিয়ে আরো দুইটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক মো: মাইনউদ্দীন খান।
টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার ডা: আমানুল্লাহ বলেন, ‘ব্র্যাকের কর্মীরা নৌকাডুবির পর পাঁচ রোহিঙ্গা নারী ও শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। এদের মধ্যে তিনজনই মৃত। এরা হলো বুচিডং ইয়ংচং এলাকার মো: ইসলামের ছেলে এনামুল (৪), আলী জোহারের মেয়ে মিনারা (৫), আবুল হাশেমের স্ত্রী জুহুরা (৬০)। অপর দুই শিশুকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রেফার করা হয়েছে। এরা হলো আহমদ নুরের ছেলে হামিদ নুর (১), আজিজুল হকের মেয়ে আজিজা বেগম (২)। বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ মাওলানা আজিজ উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলারটি বাহারছড়ার উপকূল দিয়ে অনুপ্রবেশকালে কোস্ট গার্ড বাধা দিলে ট্রলারটি ইনানীর দিকে চলে যায়।
গত ২৯ আগস্ট থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত নাফ নদী ও সাগরে রোহিঙ্গাবোঝাই ২৮টি নৌকাডুবির ঘটনায় ১৯৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের বেশির ভাগই শিশু।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/264576