৩১ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:০৯

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ২৮ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের জমির ভর্তুকি বাবদ ২৮ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকার দলীয়, নিজের পছন্দের লোক ও আত্মীয়দের কৃষক বানিয়ে লোপাট করা হচ্ছে এই টাকা। পদ্মা নদীর ধু-ধু বালুচর, পদ্মার কোলকে দেখানো হয়েছে পেঁপে ও কলার বাগান। অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মাসাতের অভিযোগ এনে এলাকাবাসী, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা সরকারের বিভিন্ন দফতরে অভিযোগপত্র পাঠিয়েছেন। এ বিষয়ে তদন্তের আদেশ দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় কর্তৃপক্ষ। তদন্তের আদেশ ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ঈশ্বরদীর হাতে এসেছে।

ক্ষতিপূরণের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ অফিস, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অফিসে জমা দেয়া হয় একটি ভুয়া তালিকা, তালিকায় পাকশী ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস একক ক্ষমতায় একাধিক স্থানে নিজের ভাতিজা, আত্মীয়, বাড়ির কাজের লোক, মোটর সাইকেলের চালক, দলের লোকজন যারা নির্বাচনের সময় তার পক্ষে কাজ করেছে তাদের নাম কৃষক হিসেবে তালিকায় দেখিয়েছে। এদের প্রত্যেকের নামে কমপক্ষে ৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। যারা কোনোদিনই চাষাবাদও করেনি কিংবা জমির মালিকও ছিল না। এদের মধ্যে রয়েছে চেয়ারম্যানের ভাতিজা আবদুল্লাহ আল কাফি ওরফে আরজু বিশ্বাসের নামে ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫২০ টাকা, আত্মীয় মৃত কেরুর ছেলে আদম আলীর নামে ৩৫ লাখ ৪ হাজার, রহমান সরদারের ছেলে চেয়ারম্যানের ড্রাইভার মন্টু সরদারের নামে ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এছাড়াও তার আত্মীয় মোহাম্মদ মোল্লার ছেলে তপন মোল্লার নামে ৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, করিম প্রামাণিকের ছেলে সিরাজুল ইসলামের নামে ৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, চেরু প্রামাণিকের ছেলে মুুকুল প্রামাণিকের নামে ৮৭ হাজার টাকা, চেরু প্রামাণিকের অপর ছেলে সজলের নামে ৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, নজরুলের ছেলে জুয়েলের নামে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭০০ টাকা, ইয়াসিনের ছেলে চান্নুর নামে ৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, করিমের ছেলে সিরাজুলের নামে ১৪ লাখ ৫৩ হাজার টাকা, উম্মেদ আলীর ছেলে বাদশার নামে ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, মহসিন খার ছেলে আ. রশিদ খাঁর নামে ২৫ লাখ ৩৫ হাজার ৬০০ টাকা, রশিদ খাঁর ছেলে লতিফের নামে ৫ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, আবুল হোসেনের ছেলে ওবাইদুর রহমান সুজা মণ্ডলের নামে ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা, আবুল মণ্ডলের ছেলে রুবেল মণ্ডলের নামে ৯ লাখ ৪১ হাজার ৪০০ টাকা, সামাদের ছেলে শিপনের নামে ২৩ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, মহসিনের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান সেলিমের নামে ১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা, হবিবুল ইসলামের ছেলে সেলিম আহমেদের নামে ৩ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, ইসলাম খাঁর ছেলে মালেক খাঁর নামে ১৭ লাখ ৭১ হাজার ৮৮৫ টাকা, শহিদুলের ছেলে লালনের নামে ২৪ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, ভোলা মালিথার ছেলে জিয়ার নামে ৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, মফেজ্জল মন্ডলের ছেলে পিপলুর নামে ১৭ লাখ ৪৪ হাজার ৮০০ টাকা, চেরুর ছেলে সজলের নামে ১১ লাখ ৯ হাজার ৮০০ টাকাসহ মোট ১২৪ জন নিজ আত্মীয়কে ভুয়া কৃষক বানিয়ে তালিকাভুক্ত করেছেন।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সাইড অফিস সূত্র জানায়, এই প্রকল্পের জন্য পদ্মা নদী তীরবর্তী কিছু আবাদি, পদ্মাচরের স্বল্প সময়ে উৎপাদিত সবজির মাঠ, অনাবাদি বালু চর ও পদ্মা নদীর কোল (ক্যানেল) বর্তমানে চররূপ কণিকা মৌজার অধীনে ৯৯৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এই জমি পদ্মা নদীর চর যার পুরোটাই খাস খতিয়ানভুক্ত।
এই খাস জমিতে রূপপুর ও দাদাপুর এলাকার কিছু কৃষক চাষাবাদ করতো। খাস এসব আবাদি জমি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করায় কৃষকেরা চিরকালের জন্য আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় জনগণ বিষয়টি ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুকে অবগত করেন। ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করতে বলেন। সেই নির্দেশ অনুযায়ী লক্ষ্মীকুন্ডা ও পাকশী ইউপির দুই চেয়ারম্যান, দুই তহশিলদার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, বন কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তা, প্রকল্পের সাইড অফিসের ইনচার্জ ও একজন প্রকৌশলীকে নিয়ে কমিটি করা হয়। এই কমিটি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করার সময় দুই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এতে তালিকা তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন পর দুই চেয়ারম্যানসহ অন্যদের স্বাক্ষরিত ৯৯৬ একর জমির অধীনে ৭৭৫ জন কৃষকের নামে ২৭ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ টাকার চাহিদা সম্বলিত একটি তালিকা অফিসে জমা দেয়া হয়। এই তালিকায় নানা রকম অনিয়ম করার বিষয় উঠে আসে।

এই তালিকার বিষয়ে পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান সেলিম বলেন, তালিকায় শতকরা ৭০ ভাগ ভুয়া কৃষকের নাম রয়েছে। এটা একটি আত্মীয়করণ তালিকা। তিনি কৃষক নন, তারপরও তার নাম ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় রয়েছে। এতে তিনি অবাক হয়েছেন। প্রকৃত কৃষক এক টাকার স্থলে ১০ টাকা ক্ষতিপূরণ পাক, মেনে নেয়া যাবে; কিন্তু ভুয়া কৃষক টাকা পাবে এটা মেনে নেয়া যায় না। তিনি বিষয়টিতে সুষ্ঠু তদন্ত দাবী করেন।
পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হবিবুল ইসলাম হব্বুল জানান, তালিকাটিতে আত্মীয় ও দলীয়করণ করা হয়েছে। এতে দলের ভাবমুর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কারণ এই নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে। তালিকা বাতিল করে পুনরায় প্রকৃত কৃষকদের নামে তালিকা করার জন্য দাবি জানান এই নেতা।
উপজেলা বন কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন, তালিকা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। কমিটিতে নাম রাখা হয়েছে তাই স্বাক্ষর করেছেন মাত্র। কারা ভুয়া আর কারা আসল কৃষক তা তিনি জানেন না বলে দাবি করেন। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, পদ্মা নদীর কোলকেও পেঁপের জমি হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেখানে মাছ থাকার কথা ছিল। কমিটিতে নাম রাখায় স্বাক্ষর করেছেন মাত্র। এর বাইরে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রওশন জামাল বলেন, কৃষকদের তালিকার বিষয়ে তিনি জানেন না। তিনি শুধু সবজির বাজার নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান শরিফ বলেন, ‘প্রকল্পের জায়গায় চাষাবাদ করা সকলের বাড়ি পাকশী ইউনিয়নের মধ্যে। তাই সেখানকার চেয়ারম্যান একক ক্ষমতা বলে এই তালিকা করেছেন।’ তবে তালিকায় ভুয়া কৃষকদের অসংখ্য নাম রয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। এই জন্য তালিকাটি বাতিল করে নতুন তালিকার দাবি করেন।
পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস জানান, তালিকায় তিনি কোন আত্মীয়করণ করেননি। যারা কৃষক তাদের নামই দিয়েছেন। তবে তালিকা তৈরির সময় দলের কিছু নেতাকর্মী অফিসে আনাগোনা করতো, রাজনীতি করার কারণে তাদের কয়েকজনের নাম দেয়া হয়েছে বলে স্বীকার করেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, যাদের বাড়ি রূপপুরে নয় তাদের এবং কিছু মানুষ যারা নিজেদের নাম অনিয়মের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করতে বলে ছিল তাদের নাম না থাকায় তারাই এসব মিথ্যা অপ্রচার ছড়াচ্ছেন।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সাইড অফিসের ইনচার্জ কে বি এম রুহুল কুদ্দুসকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘তালিকাটি দুই চেয়ারম্যান মিলে করেছে কমিটির স্বাক্ষরের মাধ্যমে অফিসে জমা দেয়া হয়েছে। এখন অনিয়মের কথা শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করা হয়েছে। সেখান থেকে যে দিকনির্দেশনা আসবে, সেভাবে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
এদিকে এই ভুয়া কৃষকের তালিকার বিষয়ে ইতিমধ্যেই তদন্তের জন্য উচ্চ মহল থেকে একটি আদেশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হাতে এসেছে বলে জানা গেছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=89903