৩১ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:০৭

সঙ্কটে ব্যাংকিং খাত

ভয়াবহ দুরাবস্থায় পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। নতুন থেকে পুরনো- সবগুলো ব্যাংকের অবস্থা শোচনীয়। এ থেকে বাইরে নেই আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকও। ‘নৈতিক দুর্বলতার’ কারণে প্রভাবশালী ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এমন দাবি করেছেন বিশ্লেষকরা। আর ব্যাংকগুলোর দুরবস্থা কতটা শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা ফুটে উঠেছে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সভায় উত্থাপিত ত্রিশটি ব্যাংকের আর্থিক চিত্রে। এখানে ব্যাংকগুলোতে প্রচুর অনিয়মের চিত্র উঠে আসায় ত্রিশ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডিকে) কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন গভর্নর ড. ফজলে কবির।
দেশের ত্রিশটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি ও অব্যবস্থাপনা খুঁজে পাওয়ায় গতকাল সোমবার জরুরী ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের ডাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। সভায় ঋণ অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দুর করতে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সতর্ক করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। পাশাপাশি কিছু দিক নির্দেশনাও দেন তিনি। বৈঠকে ৩০টি ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক সূচক উপস্থাপন করা হয়। ব্যাংকগুলোর আমানত সংগ্রহের চিত্র, ঋণ বিতরণ, আমানত ও ঋণের অনুপাত, ট্রেজারি ব্যবস্থাপনা, বিদেশি মুদ্রায় ঋণ, অফশোর ব্যাংকিং, ডলার চাহিদা, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারসহ বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়। এদিকে ব্যাংক খাতের দুরাবস্থায় হতবাক অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও। রোববার চারটি ব্যাংককে ডেকেছিল কমিটি। সেখানে উত্থাপিত প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর দুরাবস্থা উঠে আসলে তদন্ত করে ব্যাংকগুলোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রæত ব্যবস্থা নিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দেয় সংসদীয় কমিটি। সংসদীয় কমিটি বলেছে, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে। আর দায় পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়েছে ফারমার্স।

শুধু দুটি ব্যাংকই নয়; দেশের ব্যাংকিং খাতে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে। বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন কেলেঙ্কারির তথ্য। তা সত্তে¡ও আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো রয়ে গেছে দুর্বলতা, যা রীতিমতো উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা ভবিষ্যতে ব্যাংকিংখাতকে সঙ্কটের মুখে ফেলবে। যদিও এসব অনিয়ম দূর করতে এবং তদারকি বাড়াতে বিভিন্ন ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগও দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতের এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগসহ (সিপিডি) গবেষণা সংস্থাগুলো উদ্বেগ ও হতাশা প্রকাশ করে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে।

এদিকে অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক এমপি দাবি করেছেন, প্রভাবশালীদের মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নৈতিকতার জায়গা থেকে সড়ে আসার কারণেই এই ভয়ের উৎপত্তি, এমন দাবি বিশ্লেষকদের। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের দাবি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্র মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির মধ্যে থেকেই ফারমার্স ব্যাংক একের পর এক ভয়াবহ অনিয়ম করে ধংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর মাধ্যমে আর্থিক খাতকে ভয়াবহ ঝুঁকিতে ফেলায় ব্যাংকটির এমডিকে ডাকে সংসদীয় কমিটি। বেসরকারি খাতের ইসলামী, এনআরবিসি ও এবি ব্যাংককেও ডাকে অর্থমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর, যিনি সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। আর এই কমিটির কাছে সার্বিক আর্থিক বিবরণী দিতে বাধ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই প্রভাবশালী সাবেক আমলা ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে ভয় পায় কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ড. আব্দুর রাজ্জাক রোববার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘কিছুটা তো ভয় পায়ই।’

ভয়ের কারণে ফারমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলেও হলমার্ক ও বেসিক কেলেঙ্কারি সংঘটনের সময় জানার পরও লুটপাট থামাতে কী কারণে ব্যবস্থা নিতে ভয় পেয়েছিল, তা আজও জানা যায়নি। অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল, সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রæপ যখন মাত্র ৫শ’ কোটি টাকা ঋণ নেয়, তখনই জাল-জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পেরেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ (বিএফআইইউ)। তবে এই বিভাগ নিরব থাকায় সোনালী ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে যায় হলমার্ক গ্রæপ। একইভাবে বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি হাজার কোটি টাকা ছাড়ানোর আগেই খবর পায় বিএফআইইউ। বিভাগটির কর্মকর্তারা এখানেও নীরব থাকায় ব্যাংকটি থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়, যা ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা দেখছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিএফআইইউ কার বা কাদের ভয়ে তখন নীরব থেকে অর্থপিশাচদের লুটপাটের সুযোগ দিয়েছিল, আজও জানা যায় নি। এই নীরবতার জন্য বিভাগটির একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অর্থমন্ত্রণালয়।
প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভয় পাওয়ার কারণ কী- জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘ব্যাংকের বোর্ড যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। হয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নৈতিকতার জায়গা থেকে সড়ে আসায় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ভয় পাচ্ছে। আমার নৈতিকতা যখন দুর্বল থাকবে, তখনই আমি অন্য কারও অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পাবো, এটা স্বাভাবিক বিষয়।’ দেশের স্বার্থে সকল ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাজ করার আহ্বান জানান আর্থিক খাতে অনিয়মের বিরুদ্ধে সরব এই সাবেক ব্যাংকার।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক নৈতিকতার জায়গা থেকে সড়েনি, এমন দাবি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক তার ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংককে নৈতিকভাবে শক্তিশালী থেকে সকল ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ব্যাংকগুলোর অনিয়ম কঠোর হস্তে দমন করার কথা বলেছেন সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক নৈতিকভাবে শক্তিশালী না থাকলে আর্থিক খাতের অনিয়ম দুর করা সম্ভব হবে না।’

https://www.dailyinqilab.com/article/102238