৩১ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:০১

কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না

যানজট নিরসনে খরচ ৫ হাজার কোটি টাকা : ৯টি ফ্লাইওভার, ৬৬টি ফুট ওভারব্রিজ, ৩টি আন্ডারপাস নির্মাণ,
২০ জোড়া ডেমু ট্রেন, ৯টি ওয়াটার বাস, ৪২টি আর্টিকুলেটেড এবং ৩০৩টি ডাবল ডেকার বাস কেনা হয়েছে
ঢাকার যানজট নিরসনে সরকারের কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। যানজট নিরসনে ৯টি ফ্লাইওভার, ৬৬টি ফুটওভার ব্রিজ, ৩টি আন্ডারপাস নির্মাণ, ২০ জোড়া ডেমু ট্রেন, ৯টি ওয়াটার বাস, বিআরটিসির ৪২টি আর্টিকুলেটেড এবং ৩০৩টি ডাবল ডেকার বাস কেনা হয়েছিল। চালু করা হয়েছিল অটোমেটিক সিগনালিং ব্যবস্থা ও লেন পদ্ধতি। এতে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, এক দশকে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে নেমে এসেছে মাত্র ৭ কিলোমিটারে। কয়েক বছরের মধ্যে তা ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটারে নেমে আসবে। যা হাঁটার চেয়েও মন্থর। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর যানজট নিরসনের বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবসম্মত নয়। সবই প্রল্পসর্বস্ব। এ কারণে যানজট নিরসনে গৃহীত উদ্যোগ থেকে সফলতা আসছে না। এ প্রসঙ্গে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান এবং নগর পরিকল্পনাবিদ প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, যানজট নিরসনে মহাপরিকল্পনার আওতায় যে সব সুপারিশ করা হয়েছিল সেগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। সরকার অতি উৎসাহী হয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সেগুলোতে দক্ষতা ও স্বচ্ছতার অভাব ছিল। যে কারণে সমস্যা দিন দিন সমস্যাটি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

রাজধানীর যানজট নিরসনে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ ফ্লাইওভার নির্মাণ। ৯টি ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এগুলো হলো, মহাখালী ওভারপাস, খিলগাঁও ফ্লাইওভার, বিজয় সরণি-তেজগাঁও লিংক রোড ওভারপাস, টঙ্গী ওভারপাস, বনানী ওভারপাস, মিরপুর-এয়ারপোর্ট রোড ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার ও মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভার। কিন্তু সমাধান মিলছে না তাতেও। যানবাহনের অতিরিক্ত চাপে ফ্লাইওভারের দুদিকেই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। যানজট হচ্ছে ফ্লাইওভারের উপরেও। কয়েকদিন আগে মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের পুরো অংশ খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু উদ্বোধনের দিন থেকে নতুন এই ফ্লাইওভারের উপরে-নিচে দীর্ঘ যানজট লেগেই আছে।
যানজট নিরসনে রাজধানীতে সর্ব প্রথম ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ৬৬টি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এলাকা হলো, বাংলামোটর, পরীবাগ, প্রেস ক্লাব, শাহবাগ, মালিবাগ, টিকাটুলী ও ফার্মগেইট। কিন্তু এসব ফুট ওভারব্রিজ পথচারীরা ব্যবহার করেন না বললেই চলে। বরং পথচারীরা ঝুঁকি নিয়েরাস্তা পারাপার হতে গিয়ে যানবাহন চলাচলের বাধা সৃষ্টি হয়। এদিকে, প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে বনানী ও বিমানবন্দর সড়কের ফুট ওভারব্রিজে সংযোজন করা হয়েছে চলন্ত সিঁড়ি। পথচারীদের অভিযোগ এগুলো বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। ব্যস্ত এলাকা গাবতলী, কারওয়ান বাজার ও গুলিস্তানে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি আন্ডারপাস। এর মধ্যে কারওয়ান বাজারের আন্ডারপাসটি দিয়ে পথচারী পারাপার হলেও বাকী দুটি কাজে আসছে না। ভুতুড়ে পরিবেশে গাবতলীর আন্ডারপাসটি মাদকসেবীদের দখলে। আর গুলিস্তানের আন্ডারপাসটিতে মার্কেট নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, যানজট নিরসনে বিশেষজ্ঞগণ বরাবরই গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানোসহ এর ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্বারোপ করেন। সেটাকে গুরুত্ব দিয়েই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) রাস্তায় নামায় আর্টিকুলেটেড ও ডাবল ডেকার বাস। বিআরটিসির তথ্যমতে, বর্তমানে ৪২টি আর্টিকুলেটেড বাস চলছে। ডাবল ডেকার বাসের সংখ্যা ৩০৩। বিআরটিসির কর্মকর্তারা জানান, যাত্রী ওঠা-নামায় বাড়তি সময় ও ধীরগতির কারণে ডাবল ডেকার বাসকে যাত্রীরা ততোটা নির্ভরশীল মনে করে না । আর আর্টিকুলেটেড বাসগুলো ঢাকার রাস্তায় চলাচলের তেমন উপযোগী নয়। অপরদিকে, যানজট নিরসনে রাস্তার উপর চাপ কমাতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ডেমু ট্রেন চালু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। পরবর্তিতে ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর, ঢাকা-নরসিংদী রুটে চালু করা হয় ডেমু ট্রেন। ২০১০ সালে চীনের তাংশান রেলওয়ে ভেহিকেল কোম্পানি লিমিটেডের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ২০ জোড়া ডেমু ট্রেন ক্রয় করে। এতে সর্বমোট খরচ হয় ৬৫৪ কোটি টাকা। তবে অপ্রতুল যাত্রী ধারণক্ষমতা, যান্ত্রিক ত্রæটি ও রেলওয়ে অবকাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ডেমু ট্রেনগুলো এখন রেলের বোঝায় পরিণত হয়েছে।

অপরদিকে, যানজট নিরসনে ঢাকার চারিদিকে সার্কলার নৌপথ চালু সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে প্রায় ২ কোটি টাকায় ২০১০ সালে দুটি ওয়াটার বাস কেনে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডবিøউটিসি)। পরবর্তীতে কেনা হয় আরো সাতটি ওয়াটার বাস। প্রতিটির পেছনে ব্যয় হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। শুরুতে ওয়াটার বাস নিয়ে যাত্রীরা বেশ আগ্রহী ছিল। তবে অব্যবস্থাপনা, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, সমন্বয়হীনতা ও ড্রেজিংয়ের অভাব ও ১৪টি সেতুর কারণে এটি আর জনপ্রিয়তা পায় নি। বর্তমানে সদরঘাট-গাবতলী-বাদামতলী ও নারায়ণগঞ্জ-কাঁচপুর-টঙ্গী রুটে ওয়াটার বাস চললেও ঢাকার যানজট কমাতে তা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।

এদিকে, যানজট নিরসনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উদ্যোগে অটোমেটিক সিগনালিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। এজন্য নেয়া হয় একটি প্রকল্প। সেই উদ্যোগও ভেস্তে গেছে। এখন ঢাকার রাস্তার মোড়গুলোতে সিগনাল বাতি জ্বললেও গাড়ি চলে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায়। এতে প্রায়ই দেকা দেয় বিশৃঙ্খলা। বাড়ে যানজট। উল্টো পথে গাড়ি চলাচল এড়াতে ভিআইপি সড়কে কাঁটাযুক্ত প্রতিরোধযন্ত্র বসিয়েছিল পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। কয়েক দিন চললেও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এ উদ্যোগ। তবে কয়েক দিন আগে পুলিশের বিশেষ অভিযানে কয়েকজন ভিআইপির গাড়ি আটকের ঘটনায় উল্টোপথে গাড়ি চলাচল অনেক কমে এসেছে বলে ট্রাফিক বিভাগ সূত্র দাবি করেছে। এর আগে যানজট নিরসনে বিভিন্ন যানবাহনের জন্য পৃথক লেনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে চালকরা সেটি মানেননি। কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে চালকদের সচেতন বা বাধ্য করতে পারেনি। এ উদ্যোগের ফলাফলও শূন্য।

যানজট নিরসনে এসব উদ্যোগ কেনো কাজে আসছে না এমন প্রশ্নের জবাবে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞ প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, পরিকল্পিতভাবে কাজ না করলে কোনো উদ্যোগই কাজে আসবে না। তিনি বলেন, রাজধানীতে ৩০/৪০ বাগ মানুষ পায়ে হেঁটে চলাচল করে। তাদের জন্য ফুটপাতকে আরও প্রসারিত করা উচিত ছিল। কিন্তু ফুটপাতগুলো দখলে রেখেছে হকাররা। প্রায় ৪০ ভাগ মানুষের নিজস্ব কোনো যান বা পরিবহণ নেই। তাদের জন্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা দরকার। তিনি বলেন, গণপরিবহণ যা আছে সেগুলোকে সুশাসনের মধ্যে আনতে পারলেও চলতো। এ ছাড়া এসটিপির সুপারিশ অনুযায়ী বিআরটি ও এমআরটি চালুর উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ৬টি এমআরটি ও ৪টি বিআরটি একসাথে চালু করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে। তা না হলে যানজটের ভয়াবহতা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। ###

 

https://www.dailyinqilab.com/article/102211/