৩১ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৫৪

বাগে আসছে না ছাত্রলীগ

চাঁদাবাজি, ভর্তিবাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছে

লাগামহীন হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ। কোনোভাবেই বাগে আসছে না ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী এ সংগঠনটি। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ছাত্রলীগ আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘উচ্ছৃঙ্খল’ ও ‘ডোন্ট কেয়ার’ মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। নৈতিকতা মূল্যবোধসম্পন্ন নেতৃত্ব গঠন এবং গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার পরিবর্তে ছাত্রলীগের একটা বড় ও প্রভাবশালী অংশ সন্ত্রাসী, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তিবাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে সমালোচনা বিদ্ধ হচ্ছে ছাত্রলীগ। পেশিশক্তির বড়াই করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে খুন হচ্ছেন নেতাকর্মীরা। এর ফলে বন্ধ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিঘিœত হচ্ছে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। এ জন্য প্রায়ই আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ছাত্রলীগ। এসব কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলটির হাইকমান্ডও অনেকটা বিব্রত ও উদ্বিগ্ন। বেশ কয়েকবার ছাত্রলীগকে সতর্ক করে দেয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শপথবাক্য পাঠ করিয়েও কোনো ফল আসেনি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শনিবার ফেনীতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাবেদ হায়দার জর্জ ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন রিন্টু এবং তাদের অনুসারীদের নাম উঠে এসেছে। অবশ্য তারা ঘটনার সাথে জড়িত নন বলে দাবিও করেছেন। একই দিনে নরসিংদীর মনোহরদীতে বড়চাপা ইউনিয়নের ছাত্রলীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের সময় পদ ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে পুলিশসহ ছাত্রলীগের দুই কর্মী আহত হন। একই দিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের এক দোকানে চাঁদা দাবির ঘটনায় দু’পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় রাতেই তিন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। গত মঙ্গলবার মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মজিবুর রহমান অনিককে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। অভিযোগ রয়েছে, অনিকের সাথে ইডেন মহিলা কলেজের এক ছাত্রীর অবৈধ সম্পর্কের জেরে বাঙলা কলেজের ছাত্রলীগের সহসভাপতি শুভ্রা মাহমুদ জ্যোতিকে মারধর ও লাঞ্ছিত করেন তিনি। এর আগেও অনিক ছাত্রলীগের কাফরুল থানার নেত্রী ও মিরপুর বাঙলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অনার্সের এক ছাত্রীকে আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলারও এজাহারভুক্ত ২ নম্বর আসামি। সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রিয়াদ হোসেনের বিরুদ্ধে স্কুল কমিটির এক নেত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ওই নেত্রীর মামা বাদি হয়ে গত মঙ্গলবার রিয়াদ হোসেনসহ তার পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে আদালতে ধর্ষণ মামলা দায়ের করে। সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক রায়হান চৌধুরীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের পর সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে পাঁচ লাখ টাকার চেক জালিয়াতির মামলা হয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর সিলেটে ছাত্রলীগকর্মী ওমর আহমদ মিয়াদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রায়হান চৌধুরীসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। স্থানীয় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে মিয়াদ নিহত হলে ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীায় জালিয়াতির অভিযোগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক মহিউদ্দিন রানা ২০ অক্টোবর আটকের পরই তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীায় ‘জালিয়াত চক্রের’ সদস্য সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ সৌরভকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে গত ১৫ অক্টোবর থেকে দুই দিনব্যাপী থেমে থেমে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এতে ২০ জন আহত হন। গত ৬ সেপ্টেম্বর সাতীরার আশাশুনি উপজেলার কুলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বুধবার রাতে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বৃহস্পতিবার ওই গ্রামে দুর্গাপূজা উপলে নির্মাণাধীন প্রতিমাগুলো ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়। মগবাজার-মৌচাক ফাইওভার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর যশোরের চৌগাছা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম হাওলাদারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শামীম একাধিক মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি ছিলেন। একই দিনে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানার নন্দন কাননের ১ নম্বর গলিতে এক পূজামণ্ডপে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে পূজা দিতে আসা নারীসহ দু’জন গুলিবিদ্ধ হন। রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিলাস পালের বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে গত ২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কাছে তার বহিষ্কারের সুপারিশ করে। খ্রিষ্টান পাদ্রিকে অপহরণের পর তিন লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবির ঘটনায় গত ৩ অক্টোবর টঙ্গী সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শামস কবির ওরফে সৌরভকে আটক করে পুলিশ। গত ৬ অক্টোবর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস। এ ঘটনাও বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এ ছাড়াও গত ৯ মাসে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রলীগের পাঁচজন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। ছোট-বড় মিলে শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি টেন্ডার নিয়ে চট্টগ্রাম নগর ভবনে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে সাতকানিয়া উপজেলায় এক ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত নিহত হন।

৯ জুলাই বগুড়ার নন্দীগ্রামে ছাত্রলীগকর্মী রিপনের গুলিতে এক যুবক নিহত হন। বছরের শুরুতে ২১ জানুয়ারি ঢাকা কলেজের আশপাশের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের চাঁদার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগের দু’পরে সংঘর্ষ হয়। এ সময় কলেজ ক্যাম্পাসে থাকা কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়। ওই ঘটনায় কলেজ শাখা আহ্বায়ক নূর আলম ভূঁইয়াসহ ১৯ জনকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার নিজামপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক নুরুল আমিন মুহুরী নিহত হন।
এসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের অন্যতম সহসভাপতি রাজীব আহমেদ রাসেল নয়া দিগন্তকে বলেন, ছাত্রলীগ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সংগঠন। সারা দেশে অসংখ্য নেতাকর্মী রয়েছে। কোনো ঘটনা ঘটছে না, তা বলব না। তবে যেগুলো ঘটছে এগুলো ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন। ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই ছাত্রলীগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত দায়ভার সংগঠন নেবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও বলা আছে অপরাধ যেই করুক সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। অপরাধী যেই হোক কোনো ছাড় দেয়া হবে না।

এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি খোন্দকার তারেক রায়হান বলেন, যারা এসব অপরাধ কর্মকাণ্ড করছে তারা প্রকৃত ছাত্রলীগ নয়। এরা অনুপ্রবেশকারী। ছাত্রলীগের মধ্যে অন্য দলের এজেন্ট প্রবেশ করে সংগঠনের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার জন্য এসব কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। তিনি বলেন, যারা বঙ্গবন্ধু আদর্শ রক্তে বুকে ধারণ করে, সেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এ ধরনের অপকর্ম ঘটাতে পারে না।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, দল যখন ক্ষমতায় আসে, সে যে দলই হোক না কেন, কিছু সুবিধাবাদী লোক প্রবেশ করে। ওই অনুপ্রবেশকারীরাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দল ও সংগঠনের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার চেষ্টা করে। তিনি বলেন, তার পরও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, কেউ যেন দলের ভাবমর্যাদা নষ্ট করতে না পারে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/264344