৩১ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৪৯

প্রতিশোধ-প্রতিহিংসা ও ক্ষমতা লিপ্সার রাজনীতি কি বন্ধ হবে না?

বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শিষ্টাচার বিদায় নিয়েছে বলে মনে হয়। তার এই বিদায়ের পেছনে কোনও বিরোধী দল নয় বরং স্বয়ং সরকারী দলেরই সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। গত ৮/৯ বছর ধরেই এর কসরত চলছে। সরকারী দল মনে করে তারাই একমাত্র দেশপ্রেমিক। দেশে থাকা ও দেশ পরিচালনার একমাত্র অধিকার তাদেরই। যারা বিরোধী দল করেন তারা স্বাধীনতার শত্রু, বিপক্ষ শক্তি। রাজনীতি করার অধিকার তাদের নেই। এই কথাটা তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শুধু জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা তাদের আচরণের মাধ্যমেও প্রকাশ করেছেন। স্বাধীনতার ৫ দশক পরেও স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির বিতর্ক-বিভক্তি এরই একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এর একটি নিকৃষ্ট অভিব্যক্তিও আছে এবং তা হচ্ছে মতামত প্রকাশ, বাকস্বাধীনতা এবং মৌলিক মানবাধিকার থেকে বিরোধী দলগুলোকে বঞ্চিত রাখা। হামলা-মামলাসহ তাদের উপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন পরিচালনা এবং তাদের বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার। রাষ্ট্রীয়ভাবে চারদলীয় ঐক্যজোটের বিভক্তি বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে বহাল ঐক্য ও সংহতিতে ভাঙন সৃষ্টি করে তাদের আলাদা করার প্রচেষ্টা ব্যাহত হবার পর জামায়াতের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিরও ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয়। এখানে নতুন- পুরাতনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দু’টি চেষ্টাই যখন ব্যর্থ হয়, তখন জামায়াত নেতৃত্বকে খতম করে এই দলটিকে স্তব্ধ করার জন্য দলটির কিছু শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারী নির্যাতন ও হয়রানি এখনও অব্যাহত রয়েছে। তারা কোথাও বসতে পারেন না। একাধিক ব্যক্তি ঘরোয়া বৈঠকে বসলেও নাশকতা সৃষ্টি এবং সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করার তথাকথিত অভিযোগ তুলে তাদের আটক করা হয়। পুলিশী রিমান্ডে নিয়ে তাদের উপর অত্যাচার করা হয় এবং নতুন মামলায় জড়ানো হয়। ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রী সংস্থার নিরীহ ছাত্রছাত্রীরাও এই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। জামায়াতের নির্বাচিত আমীর জনাব মকবুল আহমদ, নায়েবে আমীর ও সাবেক এমপি মিয়া গোলাম পারওয়ার এবং সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানসহ আটজন শীর্ষ নেতাকে সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় বৈঠকরত অবস্থায় গ্রেফতার করে ১০ দিনের রিমান্ড দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কিন্তু তথাপিও তাদের জেলে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। জামায়াতের আমীর জনাব মকবুল আহমদকে পুনরায় তিনদিনের রিমান্ড দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

বলাবাহুল্য, সরকারী জিঘাংসার অংশ হিসেবে জামায়াতের আমীর জনাব মকবুল আহমদকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় জড়িয়ে ফাঁসি দেয়ার লক্ষ্যে তদন্ত করত: অভিযোগ গঠনের জন্য তিন তিনবার আইসিটি’র তদন্ত দল তার এলাকা সফর করেও তার অপরাধের অনুকূলে কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ পায়নি। এতেও সরকার থেমে নেই। প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের ঘায়েল করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালই হচ্ছে এখন তাদের হাতে একমাত্র সহজ অস্ত্র। কেননা এই ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে গেলে সার্বজনীন সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারী দ-বিধির চাহিদা পূরণ করতে হয় না। অভিযোগকারী সরকার ‘অপরাধ করেছে’ একথা বললেই হয়। অভিযুক্তকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেই বিচার করা ও ফাঁসি দেয়া যায়।
এখন শোনা যাচ্ছে, ফেনী জেলা মুসলিম লীগের তৎকালীন নেতা মরহুম জনাব মকবুল আহমদ উকিলের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে আনীত অভিযোগ জামায়াতের বর্তমান আমীর জনাব মকবুল আহমদের উপর আরোপ করে তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মামলা রুজু করার জন্য সরকার সবুজ সংকেত দিয়েছে। এ ধরনের গুজব যদি সত্য হয় তাহলে বলতে হবে যে, এদেশ থেকে রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার, সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠা সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে।

বিরোধী দল মাঠে নামতে পারে না, সরকারী দল লগি-বৈঠা শুধু নয়, রামদা এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মিছিল করলে নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগ ওঠে না। আবহমানকাল ধরে চলে আসা সম্প্রীতি, নীতি- নৈতিকতা ও শিষ্ঠাচার আমাদের ক্ষমতাসীন দল ও তার নেতারা বর্তমানে নস্যি বলে মনে করেন। ফলে দেশ সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র যদি সন্ত্রাস করে, দুর্নীতি ও মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে তাহলে নাগরিকরা নিরাপদ থাকতে পারে না।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার কক্সবাজার সফর উপলক্ষে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য রাস্তার দু’পাশে লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি দেখে আতঙ্কিত ক্ষমতাসীন দলের ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী কর্তৃক তার গাড়ীবহরে হামলা ক্ষমতাসীনদের দেউলিয়াপনারই প্রমাণ বহন করে।

সততা, ন্যায়পরায়ণতা, পরমত সহিষ্ণুতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা ও আদর্শ-নিষ্ঠা প্রভৃতি হচ্ছে রাজনীতির চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে এগুলো বিদায় নিয়েছে। এসব বিষয়ে রাজনীতিকদের জন্য প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা যেতে পারে। অবশ্য প্রশিক্ষণ তাদের জ্ঞান, দক্ষতা, আচার-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারবে- তা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।

দেশ একটি ক্রান্তিকালের মধ্যে অবস্থান করছে। এরমধ্যে নির্বাচনী আবহ সৃষ্টির একটি প্রচেষ্টায় অনেকেই কিছুটা আশার আলো খুঁজে পাচ্ছিলেন। কিন্তু শীর্ষ জামায়াত নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার ও রিমান্ড, দেশব্যাপী জামায়াত, বিএনপি, ছাত্রদল, শিবির ও বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় ও বেগম জিয়ার গাড়ীবহরে হামলা প্রভৃতি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ এবং সামুদয়িক (all inclusive) একটি নির্বাচনের সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিচ্ছে বলে জনমনে আশংকার সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলের উপর গত ৮/৯ বছর ধরে যে অত্যাচার-নিপীড়িন চালিয়েছেন তার স্মৃতি হয়তো তাদের মধ্যে এই আশংকার সৃষ্টি করে থাকবে যে, যদি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয় তাহলে তারা প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারেন। এই অবস্থায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদ্দেশ্যে বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর ন্যায় ভোটারবিহীন একটি নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় আসাই উত্তম- এ আশা যদি কেউ করে থাকেন তাহলে তা ঠিক হবে বলে বিশ্বাস করা যায় না। এতে সমস্যা আরো জটিল হবে।

http://www.dailysangram.com/post/305638