ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগে ডাক্তারদের মারধরের প্রতিবাদে বন্ধ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল; ইনসেটে রোগীদের দুর্ভোগ
৩০ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ১০:৪২

রোগীর মৃত্যুকে ঘিরে ঢাকা মেডিক্যালে ত্রিমুখী সংঘর্ষ

আহত ১৫ গ্রেফতার ২; তিন ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা বন্ধ; চরম ভোগান্তিতে রোগীরা

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্বজন-চিকিৎসক-আনসাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে চিকিৎসকসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছেন। ঘটনার পর চিকিৎসকেরা হাসপাতালে ইমার্জেন্সিসহ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন ভর্তি রোগীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা রোগীরা। হাসপাতালে ঢুকতে না পেরে অ্যাম্বুলেন্সেই অবস্থান করতে থাকেন তারা। আবার মুমূর্ষু অনেক রোগীকে নিয়ে বিকল্প কোনো হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকেন স্বজনরা। প্রায় তিন ঘণ্টা এভাবে চলতে থাকার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক মিটিং শেষে রোগীদের সেবা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ দিকে মারধর ও ভাঙচুরের ঘটনার সাথে জড়িত দুইজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঘটনার পর ঢামেক হাসপাতালে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

পুলিশ-চিকিৎসক ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র জানায়, গত শনিবার হার্টের অসুখ নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের করনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন নওশাদ আলী (৫২)। তাকে সিসিইউয়ের ১৭ নম্বর বেডে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু গতকাল রোববার দুপুর ১টায় নওশাদ আলী মারা যান। তার মৃত্যুর খবর শুনে নওশাদের ভাতিজা সৈয়দ ইকবাল নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক এমপি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের লোক পরিচয় দিয়ে চিকিৎসকদের ওপর চড়াও হন। একপর্যায়ে চিকিৎসকেরা তাকে শান্ত করতে গেলে তার সাথে রোগীর আরো কয়েকজন স্বজন একত্রিত হয়ে তাদের ওপর হামলা শুরু করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিসিইউ ইউনিটের প্রধান ডা: শামীম ঘটনাস্থলে পৌঁছলে তাকেও মারধর করা হয়। পরে চিকিৎসকেরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আনসার সদস্যদের সহায়তা চান। আনসার সদস্যরা সেখানে পৌঁছলে তাদের ওপরও হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ করেন চিকিৎসকেরা। একপর্যায়ে চিকিৎসক-আনসার ও রোগীর স্বজনদের মধ্যে শুরু ত্রিমুখী সংঘর্ষ। নিহতের স্বজনরা সিসিইউয়ের টেবিল চেয়ার, ওষুধ-যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করতে থাকেন। এ সময় আনসার সদস্যরা তাদের ভবনের নিচে নামিয়ে আনেন। এরই মধ্যে খবর পেয়ে নিহতের আরো স্বজন ঘটনাস্থলে পৌঁছে সংঘর্ষে যোগ দেয়। এভাবে হাসপাতাল চত্বরে চলতে থাকে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ। খবর পেয়ে শাহবাগ থানা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

কিন্তু ঘটনার পর বেলা ২টা থেকে চিকিৎসকেরা হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন। এমনকি যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তাদের চিকিৎসাসেবাও বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ করা হয় জরুরি অপারেশন কার্যক্রমও। এমনকি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের টিকিট বিক্রি বন্ধ করে সেখানে অতিরিক্ত আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। যাতে কোনো রোগী প্রবেশ করতে না পারে। এ দিকে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুমূর্ষু রোগী ঢাকা মেডিক্যালে এসে চরম বিপাকে পড়েন।
বিকেল সাড়ে ৩টায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে গেট বন্ধ করে রাখা আনসারদের কাছে গিয়ে আহাজারি করছিলেন জাকির হোসেন নামে এক ব্যক্তি। তিনি পটুয়াখালী থেকে অন্তঃসত্ত্বা ভাগ্নি ঝুমুরকে নিয়ে এসেছেন। ঝুমুরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসকেরা তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেছেন। কিন্তু তারা জানতেন না এমন বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ঝুুমুর অন্তঃসত্ত্বা। তার ডায়াবেটিস, হার্ট ও কিডনির সমস্যা আছে। পটুয়াখালী সদর হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তার অবস্থা ক্রিটিক্যাল দেখে সেখানকার চিকিৎসকেরা তাকে ঢামেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কোনো রোগীকে ভর্তি নিচ্ছে না। এখন কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না’।
কুমিল্লা দেবীদ্বার থেকে এসেছেন ডায়রিয়া আক্রান্ত আসমা বেগম। তার অবস্থা খারাপ হওয়ায় স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখান অ্যাম্বুলেন্সে করে তারা ঢামেকে এসেছেন কিন্তু এখানে কোনো রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। এমনকি রোগীদের হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনেও দাঁড়াতে দেয়া হচ্ছে না। শুধু ঝুমুর বা আসমা নন। তাদের মতো আরো অনেক রোগী দূর-দূরান্ত থেকে এসে বিপাকে পড়েছিলেন।

প্রায় তিন ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর চিকিৎসকেরা মিটিং শেষে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা শুরু করার ঘোষণা দেন। ওই মিটিংয়ে সাবেক এমপি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। তবে তিনি সাংবাদিকদের সামনে আসেননি। এ দিকে বিকেল ৫টায় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, চিকিৎসক ও আনসার সদস্যদের মারধরের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া চলছে। আগামীতে চিকিৎসকদের ওপর হামলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হবে। এ সময় তার সাথে ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যক্ষ ডা: আবুল কালাম আজাদ, ভাইস প্রিন্সিপাল ডা: শামীম, সিসিইউ ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা: ওয়াদুদ চৌধুরী প্রমুখ। পরিচালক বলেন, বহিরাগতদের হামলায় হাসপাতালের চারজন চিকিৎসক, চারজন আনসার ও তিনজন নার্স আহতসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আমরা এ ঘটনায় নিন্দা জানাই। একই সাথে অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি। এ ঘটনায় হাসপাতালের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বিষয়টি তদন্ত করে রিপোর্ট দেবে বলে জানান তিনি।
শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান জানান, চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায় সেখান থেকে রিয়াজুল ও মাতসুদ নামে রোগীর দুই স্বজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/264035